মজিবুর রহমান (কেন্দুয়া) : জন্মের পর থেকে আমৃত্যু কেউ সুখে বসবাস করেন, আবার কাউকে সারা জীবন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়। তাদের জীবনের সংগ্রাম যেন শেষ হয় না। এমনই এক সংগ্রামী পুরুষ নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়ার শহীদ খান।
৬৫ বছর বয়সী শহীদ খান বর্তমান কেন্দুয়া পৌরশহরের ওশেরপুর গ্রামের বাসিন্দা । পৈতিক নিবাস ছিল জেলার মদন উপজেলার ফতেপুর গ্রামে। তিনি ছিলেন বাবা- মায়ের এক মাত্র সন্তান। তার পিতা আবু খান প্রায় ৩৫-৪০ বছর আগে মারা যান। বাবার মৃত্যুর মাকে নিয়ে চলে যান কেন্দুয়া উপজেলার চিরাং ইউপির কাশিপুর গ্রামের মামার বাড়িতে। যৌবনকালে শহীদ খান সুটাম দেহের অধিকারী ছিলেন। একাই দুই-তিনজনের কাজ করতে পারতেন।
পরিবারের ইচ্ছায় চকবাট্রা গ্রামের ছামেদ আলীর ভূঞার কন্যার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। মামার বাড়ির লোকজনের সহায়তায় কেন্দুয়া বাজারের কাঁচামালের ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা বেশ জমজমাট চলতে লাগলো এরই মধ্যে একজন কর্মচারী রাখেন তিনি। সুখ আর ব্যবসার যশ-খ্যাতি ওই কর্মচারী রসাতলে নিয়ে গেলে। কর্মচারী হয়ে গেলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ী। লোকসানে দেউলিয়া হন শহীদ।
সংসারে ঘানি টানতে বাধ্য হয়ে হাত ধরেন রিক্সা হ্যান্ডেলে। শুরু হলো নতুনভাবে পথচলা। এরই মাঝে তিনি এক ছেলে ও পাঁচ কন্যা সন্তানের জনক হন। ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ চিন্তা থেকে আত্মীয়-স্বজনের সহায়তায় ওশেরপুর গ্রামে একখণ্ড ভূমি খরিদ করে আবাস্থল গড়ে তুলেন। তিন কন্যাকে বিয়ে দিতে পারলেও ২ কন্যা ঘরে। একমাত্র ছেলেকে বিয়ে করালেও আলাদাভাবে সংসার করছেন।
এ দিকে বিয়ে দেয়া কন্যা গত কয়েক বছর আগে মারা যান। ওই মেয়ের ঘরের নাতি, দুই কন্যা ও তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে সদস্যের সংসারের ঘানি শহীদ খানের ঘাঁড়ে।
শনিবার (৩ জুলাই) সকালে কেন্দুয়া বাসষ্ট্যান্ডে শহীদ খানের সাথে দেখা হয়। প্রতিবেদকে দেখে স্যার সম্বোধন শহীদ খান বলেন, কোথায় যাবেন? যাবো না ইশারা করলে তিনি বলে উঠেন আজ বুঝি বনি করতে পারবো না (এখনো কেউ রিক্সায় ওঠেনি আর ভাড়াও হয়নি)। প্রতিবেদক এগিয়ে এসে কি বলছেন জানতে চাইলে শহীদ তার জীবনের গল্প শুরু করেন।
এসময় শহীদ খান বলেন, রাত দুইটার দিকে রিক্সা নিয়ে বাইর (বাহির) হইছি। বাইরওনের সময় গিন্নী (স্ত্রী) কইছে (বলেছেন) চাউল নিতে। এখনো কোন ভাড়া হয়নি। চাউল কিভাবে নিয়াম (নিবেন)। আর চাউল লয়ে (নিয়ে) বাড়িতে না গেলেতো সবাইকে না খেয়ে থাকতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বেকায়দায় না পড়লে প্যাডেলের রিক্সায় এখন আর কেউ উঠতে চায় না। আমার সামনে অন্যরা মোটরচালিত রিক্সা ভাড়া নিয়ে যাইতেছে কিন্তু আমারটায় ওঠেনা। এক হলো আমার রিক্সা মটর নেই,দ্বিতীয় হলো আমি বৃদ্ধ মানুষ। অটোরিক্সা দিয়ে আমার বয়সী অনেকেই ভাল ইনকাম করছেন। আর আমি সকাল থেকে গভীর রাত পযর্ন্ত রিক্সা চালিয়ে দুশ’-আড়াইশ টাকার বেশি ইনকাম করতে পারি না। মাঝে একশ’-দেড়শ’ টাকা হয়। এই ইনকাম দিয়ে কোন মতে খেয়ে না খেয়ে সংসার চালাচ্ছি।
শহীদ খানের প্যাডেলের রিক্সাটি বহু পুরানো। প্রায় ১৭-১৮ বছর আগে এই রিক্সাটি কিনেছিলেন। বর্তমানে রিক্সা খুবই জরাজীর্ণ। অর্থাভাবে জোড়াতালি দিয়ে চালাচ্ছেন রিক্সাটি। শহীদ খান বলেন, এই বয়সে এমনিতেই জীবন চলে না,তার উপরে প্যাডেল রিক্সা। জীবন বাচঁনের লাইগা এখন গায়ের জোরে না, মনে জোড়ে রিক্সা চালাই। সবাই এখন অটোরিক্সা চালায়। আমারে নিয়ে অনেকেই টিটকারি মারে। সবই সই (সহ্য) বাবা নিরবে। আল্লায় আমার কপালে কষ্ট লেইখা রাখছে কি আর করবো।
বয়স বেশি হলেও আইডি কার্ডে বয়স কম থাকায় বয়স্কভাতার কার্ড হয়নি। এখন মনে হয় হইব আইডি কার্ডে বয়স ৬৫ হয়েছে। করোনা না থাকলে সারারাত গাড়ি চালাইতাম। অটোরিক্সা যারা চালায় তারা রাতে অনেকেই গাড়ি চালায় না। এই সুযোগে রাতে ভাড়া মারতাম। ইনকাম ২-৩শ’ টাকা হতো। লকডাউনের কারণে রাতে যাত্রী নেই। দিনের বেলায় তো আমার রিক্সায় অনেকেই উঠেন না। এখনতো কামাই রোজগার এরকম বন্ধ হয়ে গেছে। কিভাবে সংসার চালাবেন সেই চিন্তায় এখন ঘোরপাক খাচ্ছেন তিনি।
শহীদ খান বলেন, একটা অটোরিক্সা হলে শেষ বয়েস একটু হলেও শান্তি পেতাম। তার এই দুঃসময়ে কোন সহৃদয়বান ব্যক্তি পাশে দাঁড়ালে কৃতার্থ হবেন বলে জানান তিনি।