
অনিমেষঃঃ সুবাইতা সারোয়ার। চার বছরের এক ফুলকুঁড়ি । বুদ্ধিদীপ্ত চোখ-মুখ তার সহজেই আকর্ষণ তৈরি করে যে কাউকে। তবে ভাব জমানোটা তার সাথে খুব সহজ নয়। সবকিছুতেই যেনো তার পরিমিত প্রতিক্রিয়া। মনে হয় যেনো- পরিমিতির পরিমাপে ভাবের একেকটা প্রকাশ তার। এটাকে তার বাবা বলে ‘ভাব ধরা’। অবশ্য বাবার সাথেই বেশি ভাব তার। সমস্যা হলো, বাবার সাথে ভাব-ভালোবাসার এত অবাধ সুযোগ কোথায় ! শ্রমজীবি বাবা তার। রোজই সকালে চলে যেতে হয় কর্মস্থলে। হয়তো কোনদিন সুবাইতাকে ঘুমে রেখেই। মনোবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন- মানুষের দ্রুততম বিকাশ হয় শৈশবের শুরুতে। ছয় মাসের মধ্যেই মানুষের মস্তিষ্কের অর্ধেক গঠিত হয়ে যায় এবং আট বছরের মধ্যে তৈরি হয় ৯০ শতাংশ। শিশুর বুদ্ধিবৃত্তি, আবেগ, সামাজিক যোগাযোগ ও শারীরিক সম্ভাবনা বিকাশের জন্য এই পর্যায় ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শ্রমজীবি পরিবারে কি এত বিষয় খেয়াল রাখা সম্ভব? সুবাইতার মা-ও গৃহিণী। দিনে সংসারের হাজারটা কাজ-কর্ম তাকে সামলাতে হয়। তাই সুবাইতাকে দিনের অধিকাংশ সময়টি একলাই কাটাতে হয়। পুতুল নিয়ে খেলতে বসে তাকে একাই হয়তো কনের মা, বরের মা সাজতে হয়। কনে সাজতে দেরি করছে, বর কেন আসছে না-এসব তাগিদ নিজেকেই নিজে দিতে হয়। তেমনি হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে খেলতে বসেও নিজের রান্না নিজেকেই খেতে হয়। রান্নাতে লবণ কম কি বেশি হয়েছে-এটা বলারও কেউ নেই। গ্রামে বড় হওয়াতে কিছু বিশেষ আনন্দ আছে । যেমন- শন পাঁপড়ি বা হাওয়াই মিটে যাওয়ার সময় ফেরিওয়ালার ডাকে সব বাচ্ছারা পিছু নেয়, যেনো হিমালয়ের বাঁশিওয়ালা ছুটছে। শহরে হিমালয়ের বাঁশিওয়ালা বা কাবুলিওয়ালাদের বিশেষ একটা পাওয় যায় না। কারণ শহরের বাড়িগুলোর সদর দরোজায় যে কড়া লাগানো থাকে তার ফোঁকড় দিয়ে কেবল কাবুলিওয়ালা বা বাঁিশওয়ালাদের দেখা যায়। কিন্তু তার পিছু নেয়া যায় না। সুবাইতাও মাঝে মাঝে বাড়ির ফটক পেরিয়ে পথে যেতে তার মতো কিছু শিশুদের দেখতে পায়। কিন্তু তাদের সাথে মিশে যেতে পারে না। খোলা আকাশ দেখতে পায়, কিন্তু আকাশে ডানা মেলাতে পারে না। অথচ তার খোলা আকাশ, খোলা মাঠ দেখার শখ। শহুরে জীবন, শখ হলেই কি এই শখ মেটানো যায়? সুবাইতার শখ, ইচ্ছেও মিটে না। ধীরে ধীরে খোলা ইচ্ছেগুলো তার বাক্সবন্দি হয়ে যায়। শখ তখন হয়ে উঠে মুঠো ফোনের মধ্যে, ইচ্ছেগুলো আটকে যায় কী-প্যাড আর মনিটরের পর্দায়। তাই বাবা বাসায় আসলেই বাবার ফোনটি তার চাই। যেনো সারাদিন এটির জন্যই তার প্রতীক্ষা। একদিন এক শুভ্র সকালে সুবাইতার ইচ্ছে হলো- বাবার সাথে পার্ক ঘুরে আসবে। পার্কের পাশে যে নদী এবং নদীর বুকে যে নৌকা চলে- এইসব তার দেখার ইচ্ছে হলো। পার্কে প্রবেশ করার আগেই সুবাইতার চোখে পড়লো একটি বিরাট মাঠ। মাঠের সবুজ ঘাসের উপর খেলা করছে বিভিন্ন বয়সী ছেলে-মেয়েরা। কেউ ক্রিকেট, কেউ ফুটবল কেউবা অন্যটা খেলছে। মাঠের চারপাশে দৌড়াদৌড়ি করছে ছোট ছোট বাচ্ছারা। এসব দেখে সুবাইতার মনে পড়ে গেলো তার পুরনো শখের কথা- খোলা মাঠ দেখার ইচ্ছে তার কতদিনের ! ভাবলো- এই মাঠটি যদি তার হয়, তাহলে তো তার খোলা জায়গা আর খেলার সঙ্গীদের কোন অভাবই হবে না। উচ্ছ্বসিত সুবাইতা সাথে সাথে তার বাবার কাছে আবদার জানালো- “বাবা, এটির মত আমাকে একটা মাঠ কিনে দিও ?”