রবীন্দ্রনাথ পালঃ করোনায় বিশ্ব বিবেক যেখানে আজ মুখ থুবরে পড়েছে,তখন আমাদের এই সমাজে এখনো কিছু বিবেকবান মানুষ আছে,যাদের মনুষ্যত্ব ও মানুষকে সেবা দেবার স্পৃহা দেখলে,তাদের স্যালুট দিতে হয়।
একটা সমাজের যখন ভালো মানুষগুলোকে ছাপিয়ে সমাজের সুবিধাভোগীরা নিজেদের গুনকীর্তনে ব্যস্ত,তখন কিছু ভা্লো আর বিবেকবান মানুষরা গোপনে জাতি ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে এমন কিছু ভালো কাজ করেন তা ছাই দিয়ে চেপে রাখা যায়না। আর সত্যটা প্রকাশ হলে ধর্মের দোহাই দিয়ে নিজেদের বড় বানাতে ফেসবুকে ট্যাটাস দিয়ে নিজের ঢোল নিজে বানাতে মরিয়া হয়ে উঠে। সত্যিটা কখনো ধামাচাপা দেয়া যায় না। সত্য প্রকাশ হবেই। এটাই নিয়তির বিধান। আশা করবো আমার লেখাটা কষ্ট করে হলেও যদি কেউ পড়েন,তাহলে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করবো।
যাক সোজাসুজিই বলে ফেলি। গত ৭ই জুন ময়মনসিংহ জজ আদালতের সিনিয়র সহকারী জজ উমা দাসের স্বামী ডঃ দেবাশীষ দাস করোনায় আক্রান্ত হয়ে এস কে হাসপাতালে মারা যান। মাত্র আড়াই বছরের একটি ছেলে রেখে স্ত্রী উমা দাসকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। ঈশ্বরের কাছে।
সত্যি বলতে কি উমা দাস সাহসী মহিলা। তা না হলে করোনায় মৃত স্বামীর লাশ এ্যাম্বুলেন্স করে সাথে নিয়ে তিনি নিজে একাই শশ্বানে চলে যেতে পারতেন না। অথচ শশ্বানে কেউ তার পরিচিত নয়। হয়তো স্বামীর লাশ না হলে তিনি শশ্বানে কোনদিন যেতেন কি না সন্দেহ। যাক লাশবাহী গাড়ী নিয়ে শশ্বানে গিয়ে চুপচাপ গাড়ীতেই বসে ছিলেন। হয়তো ভাবছিলেন কিভাবে স্বামীর শেষকৃত্য সম্পন্ন করবেন। অজানা নানা শংকায় তিনি যখন মৃত স্বামীর লাশ বহনকারী গাড়ীতে বসে ভাবছিলেন,তখন বীর মুক্তিযোদ্ধা যাকে সবাই চিনে মুক্তিযুদ্ধের ফেরিওয়ালা বলে বিমল পাল,সমাজসেবক অালী ইউসুফ, অাশরাফ উদ্দিন,তারাকান্দার বিনায়ক দত্ত,সাফ্রান ও শশ্বানের লাশবাহী গাড়ীর চালক অমল দত্ত। তখন বেলা দুইটা/আড়াইটা হবে। সমাজসেবী হিসেবে অালী ইউসুফের সুনাম আছে এই শহরে। আর বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল পালকে একডাকে সবাই চিনে একজন নিরংকার,নির্লোভ ওপরোপকারী হিসেবে। বাকীদের মধ্যে অমল দত্তকে চিনি শশ্বানের লাশগাড়ীর চালক হিসেবে।
সহকারী জজ উমা দাসের স্বামী ডঃদেবাশীষ দাস করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার সংবাদটি পান আলী ইউসুফ মটর মালিক সমিতির রবিউল ইসলাম শাহীনের কাছ থেকে। কারন তিন মাস আগেই আলী ইউসুফ ফেসবুকে পোষ্ট দিয়ে জানিয়েছিলেন কেউ যদি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান তবে সেচ্ছাসেবী হিসেবে দাফন বা সৎকারের কাজে তাদের ডাকলেই পাওয়া যাবে। শাহীনের কাছ থেকে সংবাদ পাবার পরপরই সিটি করপোরেশনের পুষ্টি ও স্যানিটারী পরিদর্শক দীপক মজুমদারের কাছ থেকেও সংবাদ পান ইউসুফ।
সবার আগে শশ্বানে যান বিমল পাল। এরপরই অাসেন ইউসুফ, আশরাফ উদ্দিন, সাফ্রান। পরে যোগ দেন তারাকান্দার বিনায়ক। তারা লাশবাহী গাড়ীর পাশে গিয়ে উমা দাসকে গাড়ী থেকে নামতে বলেন। শান্ত উমা দাস গাড়ী থেকে নেমে এলে ডঃ দেবাশীষ দাসের মরদেহ গাড়ী থেকে নামিয়ে আনেন বিমল পাল,আলী ইউসুফ, অমল দত্ত ও আশরাফ উদ্দিন।
গাড়ী থেকে লাশ নামিয়ে লাশ ধোয়ার জন্য লাশের শরীর থেকে বডিব্যাগ,শরীরের জামাকাপড় খুলে ফেলেন বিমল পাল,আলী ইউসুফ, অমল দত্ত। লাশকে ধৌত করনের জন্য যখন পাইপ দিয়ে জল ঢালতে থাকেন ইউসুফ ও বিমল পাল, তখন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেন স্তব্ধ থাকা উমা দাস। তিনি সমস্ত ভীতি, আশংকা দূরে সরিয়ে স্বামীর মরদেহটি স্বযত্নে ধৌত করেন।
এ সময় সেখানে আসেন হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের এড, বিকাশ রায় ও এড রাখাল সরকার। যাক মরদেহ ধৌত করনের পর চিতায় উঠানো হয়। উমা দাস প্রথমে তার ছেলের হাতে ছোঁয়া দুটি পাটখড়ি দিয়ে চিতায় সাজানো স্বামীর লাশের মুখান্গি করেন। এরপর বিমল পাল ও আলী ইউসুফ পাঁচবার ঘুরে মুখাগ্নি করেন। বিনায়কের করোনা সরঞ্জাম একটু ছেঁড়া থাকায় তাকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। অমল দত্ত তাদের সহায়তা করেন। আশরাফ ও সাফ্রিন সব সময় বিমলদা ও ইউসুফ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছিলেন।
চিতায় লাশে আগুন দেয়ার আধাঘন্টা পর এড,বিকাশ ও এড রাখাল চলে আসেন শশ্বান থেকে। আর কিছুক্ষন পর বিমল দা আলী ইউসুফ, আশরাফ উদ্দিন,সাফ্রান ও বিনায়ককে বিদায় করে দেন শশ্বান থেকে। সেখানে থেকে যান উমা দাস,বিমল পাল ও শশ্বানের গাড়ী চালক অমল দত্ত দাহ সম্পন্ন করে সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায়। এরপর সবাই চলে আসেন শশ্বান থেকে।
এমন একটি হৃদয় বিদারক ঘটনাকে পুঁজি করে যারা নোংরা রাজনীতি করেন, আমি তাদের ঘৃনা করি। করোনায় মারা যাওয়া সন্তানের লাশ যখন বাবা গ্রহন করছে না। ৪০/৫০ দিন হাসপাতালের হিমঘরে পড়ে থাকে, তখন বিমল পাল ও আলী ইউসুফ গংরা যা করলেন, তা অসাম্প্রদায়িক ময়মনসিংহের জন্য একটি উজ্জল দৃষ্টান্ত। সিটি করপোরেশন লাশ দাফন ও সৎকারের জন্য কমিটি করতে পারেন,তাতে আমাদের কোন সমস্যা নেই। তবে করোনা আতংকে সবাই যখন ভীত সন্ত্রস্থ, সে সময় বিমল পাল, আলী ইউসুফ, আশরাফউদ্দিন, সাফ্রান,বিনায়ক ও অমল দত্তরা যা করলেন, তাদের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ছোট করার অধিকার আমার নেই। তারা বীর যোদ্ধা। সন্দেহ নেই।
আমি বিনিতভাবে মিনতি জানাই উমা দাসের স্বামী দেবাশীষ দাসের শেষকৃত্য নিয়ে কেউ পানি ঘোলা করবেন না। কেউ ধর্মীয় দৃষ্টকোন থেকে বিচার না করে স্বর্গীয় ভুপেন হাজারিকার কন্ঠে তাল মিলিয়ে বলি মানুষ মানুষের জন্য। জীবন জীবনের জন্য। একটু ভালবাসা কি পেতে পারে না। ও বন্ধু। স্যালুট বিমল পাল, আলী ইউসুফ, আশরাফ উদ্দিন ও সাফ্রানকে। পরম করুনাময় আপনাদের মানুষের সেবায় আরো উদ্যমী, সাহসী ও বিবেক ও মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করে সমাজে অসাম্প্রদায়িক চেতনা আরো বৃদ্ধি করুন — এই প্রত্যাশা রইলো।