হৃদয়ের কতটা রক্তক্ষরণের হইলে বিভীষণ ঘর শত্রু হইয়াছিলেন তাহা আমার জানা নাই। বিভীষণ যে আমার খুব প্রিয় চরিত্র তাহাও নহে, কিন্তু কেন জানি আজ বিভীষণ না হইয়া উপায় নাই।ময়মনসিংহের অক্সফোর্ড খ্যাত ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের এস এস সি এর রেজাল্টের ভয়াবহ ধ্বসই আমাকে এইরূপ বিচলিত করিবার মুখ্য কারণ।
ছাত্র অবস্থায় অনুর্বর মস্তিষ্কের অধিকারী আমি বুয়েট পড়ুয়া বন্ধু কাজী সামিন ইয়াসার প্রান্ত’র কল্যাণে জিলা স্কুলের অষ্টম শ্রেণি হইতে উত্তীর্ণ হইয়া নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়িবার সুযোগ পাইয়াছিলাম।উহার পর হইতেই যত গোলযোগ আরম্ভ হইয়াছিল।
নবম শ্রেণিতে ওই আভোগেড্রোর সূত্র আর পানির রাসায়নিক সংকেত এইচ টু ও ছাড়া আর কিছু জানিতাম কি না তাহা আমার মনে নাই। আনোয়ার কাদের স্যারের প্রাইভেটে পরীক্ষায় পদার্থ বিজ্ঞানের অংক ঐকিক নিয়মে সমাধানের আপ্রাণ চেষ্টাও যে বরাবরই অসফল হইয়াছিল তাহা বলার অপেক্ষা রাখে না।উচ্চতর গণিতের ইংরেজি heir math নহে, তাহা যে Higher math হইবে,তাহা নবম শ্রেণির মাঝামাঝিতেই জানিয়াছি আবির পণ্ডিতের সহায়তায়। তাহারপর কোন রকমে ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করিয়া নবম শ্রেণি হইতে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হইয়াছিলাম। দশম শ্রেণিতে টেস্ট পরীক্ষার পূর্ব পর্যন্ত যে কিরূপ বকলম ছিলাম তাহা আমার বাপ মা ছাড়া বাকি সবাই যে জানিত এ বিষয়ে কোন দ্বিধা আমার নাই। টেস্ট পরীক্ষার পর গৃহশিক্ষক আর নিজের আপ্রাণ চেষ্টায় কোন রকমে পদার্থ রসায়নের প্রথম দিকের কয়েকখানা অধ্যায় আত্মস্থ করিয়া এস এস সি নামক যুদ্ধক্ষেত্রে অংশ গ্রহণ করিয়াছিলাম।পরীক্ষার হলে রিটেন অংশটুকু নিজে নিজে কাভার করিতে পারিলেও নৈর্ব্যক্তিকের নিমিত্তে নির্ভরশীল হইতাম শুভ আর সনেটের উপর। বিষয়টা এমন নহে যে ওহাদের নৈর্ব্যক্তিক দাগানোর উপর পি. এইচ. ডি ডিগ্রী ছিল,নেটওয়ার্ক ভাল হইবার দরুন ওহারাও নৈর্ব্যক্তিকের উত্তর গুলো কালেকশন করিত ওয়াজেদ উল্লাহ মুরাদের মস্তিষ্ক হইতে।
অত:পর বিজ্ঞান শাখায় I was GPA 5 হইয়া, বিজ্ঞানের প্রতি মারাত্মক বিতৃষ্ণা লইয়া নটর ডেম কলেজে মানবিক শাখায় ভর্তি হয়েছিলাম।
নটর ডেম কলেজের কুইজ পরীক্ষা গুলোতে ঘাড় ঘোরানোর সুযোগ না পাওয়া আমি দুই বছরে এইটুকুই শিখিয়াছিলাম হবস-লকসের সোস্যাল কট্রাক্ট, রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্ব আর যুক্তিবিদ্যার অনুপপত্তি সমূহ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্বীয় অনুর্বর মস্তিষ্কের উপর ভর করেই লিখিতে হইবে। তাহার দরুন I was GPA 4.60 লইয়া নিতান্ত প্রেমের তাড়নায় ময়মনসিংহে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং এ ভর্তি হইয়াছিলাম। লাকি ভাই আর সুহেল ভাই এর কল্যাণে বিশ্ববিদ্যালয় একটা জুটিয়াছিল বটে কিন্তু সাধের ঢাবি ভর্তি পরীক্ষার স্মৃতি আমি আজও ভুলিতে পারি নাই। ঢাবি পরীক্ষার হল থেকে বাহির হইয়া আবিষ্কার করিয়াছিলাম সিগমন্ড ফ্রয়েডই যে আধুনিক মনোবিজ্ঞানের জনক আর পদ্মা সেতু তৈরির মহান দায়িত্ব লইয়াছিলেন চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি এই দুইখান উত্তর আমি জানা সত্ত্বেও ভুল দাগাইয়া আসিয়াছি। ইন্টারের জিপিএ ভাল থাকিলে জাহাঙ্গীরনগরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে প্রথম হইতাম এই বলিয়া আজও নিজেরে সান্ত্বনা দেওয়া আমি অবশেষে ভর্তি পরীক্ষার সিরিয়ালে ১১১৮ হইতে কিভাবে যে জগন্নাথের ইংরেজি বিভাগের জন্য ডাক পাইয়াছিলাম তাহা আমি মরিবার পরে স্বর্গে আপেল, আঙ্গুর কমলা খাইতে খাইতে উপরওয়ালকে অবশ্যই জিগাইবো। ইয়েটস, বাইরন আর কিটসের কবিতার লাইন তালুতে, বেঞ্চিতে বা পয়সা রাখার থলেতে লিখিয়া, ব্যারোকার আরেকটা বউয়ের নাম যে আইলাতু ছিল তাহা না জানিয়াই আমি অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে গেল বছর পাস করিয়াছি।
ময়মনসিংহ ফিরিয়া আসিয়া এক খানা ছোট খাট কলেজে আর কোচিং এ শিক্ষকতা শুরু করিয়াছি। এত চাওয়া আর না পাওয়ার মধ্যে অর্জন এই খানিই যে যতটা পারিয়াছি নিজের যোগ্যতায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইবার চেষ্টা আমি করিয়াছি। হ্যাঁ নকল আমি করিয়াছি সন্দেহ নাই কিন্তু পরীক্ষার হলে বসিয়া সমুদ্র চুরি করি নাই। যাহাই হোক ময়মনসিংহে ফিরিয়া আসিয়া ছোট খাট শিক্ষক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করিতে যাইয়া আবিষ্কার করিলাম এই নগরী অন্য সব নগরীর মত নহে। এখানে মাষ্টারের কামাই ডাক্তারের হইতে ঢের বেশি খালি গালের দুইপাশ একটু বেশি নাড়াইলেই হইবে। শিক্ষা কার্যক্রমের মোটামুটি ইতি ঘটাইয়া এই কয়েক মাসে অনেক কার্য আমি সাধন করিয়াছি। ক্লাস নিয়াছি, ইন্টারনেট ঘাঁটিয়া পোলাপানের জন্য অত্যাধুনিক প্যারাগ্রাফ, রিপোর্ট কম্পোজিশন, কবিতার সামারির নোট তৈয়ার করিয়াছি, পরীক্ষার হলে গার্ড দিয়াছি আর হাজার খানেক খাতা দেখিয়াছি সব মিলাইয়া। পরীক্ষার খাতায় কলম পাচার করিতে যাইয়া আবিষ্কার করিয়াছি ছাত্র আমার প্রধান শিক্ষক বরাবর লিভ ইন এডভান্স এপ্লিকেশন লিখিয়াছে “my parents marriage ceremony will be held on 23rd November, 2019. So I need leave in advance”। ইংরেজি বাগধারা bed of roses মানে মন্দ গোলাপ আর bad blood মানে মন্দ রক্ত হইবে জানিলে আমি অনেক আগেই বি সি এস পরীক্ষার্থীদিগকে তাহা জানাইয়া দিতাম। আর এই পরীক্ষার খাতাসমূহ বিতরণ কালেও আমার বিড়ম্বনার অন্ত থাকিত না।
একবার,জিলা স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির এক ভদ্রলোক আসিয়া দাবী করিয়াছিল তাহার প্যারাগ্রাফে আমার দশে সাত দেওয়া ঘোরতর অন্যায় হইয়াছে, আমি বিলম্ব না করিয়াই বিদ্যাময়ীর ফার্স্ট গার্ল সাদিয়ার খাতা বাহির করিয়া দেখাইয়াছি আর বলিয়াছি এই মেয়ের খাতাখানা দেখ তাহলেই ঠাহর করিতে পারিবা তোমার ওই সাত নাম্বার অনেক বেশি হইয়া গেছে। ভদ্রলোক চলিয়া গিয়াছিল বটে কিন্তু বিকালেই যে গার্ডিয়ান সমেত হানা দিবে তাহা আমি বুঝিতে পারিলে দশে বিশ দিয়া দিতাম। গার্ড দিবার কালে ছাত্রীদের খাতা ছিঁড়িয়া ফেলা, পরীক্ষার হলে জীবনে দেখা দেখি করি নাই এমন বক্তব্যও দিয়াছি। নিজের বাসার বারান্দায় একখানা ইংরেজির দোকান খুলিয়াছি। এইচ এস সি র ব্যাচ পড়াইয়াছি, ছাত্র ছাত্রীদের ট্রিট দিয়াছি, এক খানা ইংরাজি ব্যাকরণ বই লিখিব বলিয়াও ভাবিয়াছি। শিক্ষকতা সম্পর্কিত এহেন কোন কার্য নাই যাহা সম্পাদন করি নাই। তবে সবচেয়ে বেশি প্রত্যক্ষ করিয়াছি আমার অক্সফোর্ড খ্যাত জিলা স্কুলের ছাত্রদের, হাজার হোক এই স্কুলে আমি পড়িয়াছি। কিন্তু সেই জিলা স্কুল আর এই জিলা স্কুলের যে আকাশ কুসুম পার্থক্য হইবে তাহা কি কখনও কল্পনা করিয়াছিলাম
এক পরিচিত গার্ডিয়ান একদিন জানাইয়াছিল তাহার সন্তান নবম শ্রেণি হইতে দশম শ্রেণি উত্তীর্ণ হইতে পারে নাই তার প্রেক্ষিতে নাকি তাহাকে ছাত্র সমেত প্রধান শিক্ষিকার সহিত দেখা করিতে হইবে। ছাত্র মহাশয়কে আমি এত ভাল করিয়াই জানিতাম তাই আমি সেই অভিভাবককে বলিয়াছিলাম আপনি প্রধান শিক্ষিকাকে, ছাত্রকে দশম শ্রেণীতে উঠাইবার অনুরোধ না করিয়া বরঞ্চ শুধাইবেন বাকি যে কয়েকটা সাবজেক্টে পাশ করিয়াছে তাহা কিভাবে সম্ভব হইল। পরবর্তী বাক্যালাপে জানিতে পারিয়াছি মহিলা আমার কথা মতই কাজ করিয়াছিলেন কিন্তু প্রধান শিক্ষিকা নিজেই অভিভাবকে উলটা বুঝাইয়া গুণধর ছাত্রটিকে দশম শ্রেণিতে উঠিবার টিকেট দিয়াছিলেন।
মেট্রিক পরীক্ষা হল অভিমুখী এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করিয়াছিলাম “কি হে প্রিপারেশন কেমন?” উত্তর আসিয়াছিল তাহা পরীক্ষার হলের কেমন গার্ড পরে তাহার উপর নির্ভরশীল। নৈতিকতার গ্রাফ কতটুকু ডাউনওয়ার্ড ট্রেন্ড মেইন্টেইন করিলে একটা কক্ষে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ২ ঘণ্টা একটানা গার্ড দেয় তাহার আমার গোবরভর্তি মাথায় ঢুকে না। একটা সময় জিলা স্কুলের ছাত্রদের পরীক্ষা দিতে দেখিলে ম্যাজিস্ট্রেট বলিতেন এই রুমে সব ম্যাজিস্ট্রেটগণ পরীক্ষা দিতে বসিয়াছেন আর এখন দাবি করেন ঠিক মত গার্ড বসাইলে জিলা স্কুলে পাশের হার ১০ পার্সেন্টও থাকিবে না। আমাদের সময় ৫ জন GPA 5 মিস করিত কিনা আমার মনে নাই আর এখন জিলা স্কুলে ৭/৮ জন ফেল। একজন নাকি নিজের মর্জি বসত পরীক্ষায় বসে নাই।
এই অধঃপতনের শেষ কোথায় তা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই জানেন। আমার খুব স্পষ্ট ভাবে মনে পড়ে নাজির স্যার, হাবিব স্যার, সমরেশ স্যার, আজাহার স্যারের কথা। স্যারদের বদলি রুখবার জন্য ছাত্রদের আন্দোলনও করিতেও দেখিয়াছি। এখন নাকি শিক্ষকরাই ছাত্রদের ভয় পান। ছাত্রদের বেত্রাঘাত করিলে নাকি গার্ডিয়ান ডিসি অফিসে লিখিত অভিযোগ দিতেও দ্বিধা বোধ করেন না। সেই ভয়ে আমার শিক্ষকগণ এখন ছাত্র পিটায় না। একসময়ের আমাদের সর্বোচ্চ ভাল চাওয়া আমার শিক্ষকগণ এখন নিজেরাই ভীত সন্ত্রস্ত। বাপ চাচার আমলের অক্সফোর্ড মৃত্যুঞ্জয় স্কুল এখন মৃতপ্রায় করতোয়া নদী আর অদূর ভবিষ্যতে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল যে ইতিহাসের ট্রয় নগরী হইবে না তাহার কোন গ্যারান্টি কেহ দিতে পারিবে না তাহা আমি নিশ্চিত, তবে এই ট্রয় নগরীর হেলেন হবে যে অক্সফোর্ড গার্ডিয়ান সমাজ তাহাতে কোন ভুল নাই।
রাতুল পাল
লেখক
ময়মনসিংহ