পরশ মির্জা ঃ গত ১৮ মে ২০২০ তারিখ সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের উজানধল গ্রামে রাতের অাঁধারে বাউল সম্রাট শাহ অাব্দুল করিমের ভাবশিষ্য বাউল রণেশ ঠাকুরের গানের ঘরটি পুড়িয়ে দিয়েছে। যে ঘরটিতে ৪০ বছর যাবত বেঁজে উঠতো বাংলার মেটোসুর। বাউল রণেশ ঠাকুরের গানের পান্ডুলিপি, সকল বাদ্যযন্ত্র পুড়ে ছাঁই হয়ে যায়।
অাগুনে পুড়িয়ে দেয়ার এই হিংস্র বর্বর কান্ড কি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা? কখনোই নয়। অতীতেও হিংস্র হায়েনা শাবকেরা বারবার হামলে পড়েছে বাঙালী জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাংলার প্রাণ লোকজ বাউল সংস্কৃতির উপর। তারই ধারাবাহিকতায় বাউল রণেশের গানের ঘরটি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
বাউল শাহ অাব্দুল করিমের জীবদ্দশায় তাকে যে ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী নিগ্রহ করেছিল তার সাথে এই ঘটনার যোগসূত্র রয়েছে। শাহ অাব্দুল করিম একাধারে ছিলেন গণসঙ্গীত রচয়িতা, গণসঙ্গীত শিল্পী। ছিলেন বাউল সাধক, বাউল গান রচয়িতা, বাউলশিল্পী। গণসঙ্গীতে তিনি গণমানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। বলেছেন গণমানুষের মুক্তির কথা, স্বাধীনতার কথা। পাকিস্তান অামলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুনামগঞ্জে জনসভায় গেলে তিনি শাহ অাব্দুল করিমের গণসঙ্গীত না শুনে জনসভার মঞ্চ ত্যাগ করেননি। বাউল গানের মাধ্যমে শাহ অাব্দুল করিম সৃষ্টিকর্তা, সৃষ্টিতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, মানুষের কথা, জীবনের কথা, ধর্মের নিগূঢ় বাণী-সত্য ও সুন্দরের কথা বলেছেন। এসব মন:পুত হয়নি ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর। তারা পিছু লেগেছিল। ধর্মান্ধ গোষ্ঠী শাহ অাব্দুল করিমকে একঘরে রাখার অপচেষ্টা করেছিল। বিভিন্নভাবে নিগ্রহ করার অপকৌশল নিয়েছিল। ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর নানাবিধ অত্যাচারে শাহ অাব্দুল করিম মানসিকভাবে যখন ভেঙ্গে পড়েন তখন তাঁর পাশে দাঁড়ান বাউল রণেশের পিতা, ভাই রুহী ঠাকুরসহ তিনি নিজে। শাহ অাব্দুল করিমের বাউল সম্রাট হয়ে উঠার পেছনে উজানধলের এই ঠাকুর পরিবারের রয়েছে অতি অবদান যা অনস্বীকার্য।
নিজে বাউল হয়েও নিজের গান না গেয়ে প্রচার না করে বাউল রণেশ তার গুরু বাউল সম্রাট শাহ অাব্দুল করিমের গান গেয়ে প্রচার করেছেন। গ্রাম থেকে গ্রামে, এক অনুষ্ঠান থেকে অারেক অনুষ্ঠানে গুরুর গান গেয়ে ছুটে চলেছেন। ফলে জনপ্রিয় হয়ে উঠে বাউল সম্রাট শাহ অাব্দুল করিমের গান। এতে ক্ষুদ্ধ ছিল সেই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী যারা বাউল সম্রাট শাহ অাব্দুল করিমকে নিগ্রহ করেছিল। সেই ক্ষুদ্ধতা থেকেই বাউল রণেশ ঠাকুরের গানের ঘর রাতের পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তাই অাগুন লাগানোর এ কান্ড কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা ধাারাবাহিক অাক্রমণের পর্ব মাত্র।
বাউলগান অসীমের উদ্দেশ্যে সসীমকে সপে দেয়ার কথা বলে। হিংস্রতা নয়, কোমলতার কথা বলে। ফলে বাউল ও বাউল সাধকগণ কোমল মনের অধিকারী হন। মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকেন। দূরে থাকেন ভোগবাদ ও লোভবাদ থেকে। তাদের সহজাত স্বাভাবিক জীবনযাত্রাই তার সাক্ষ্য বহন করে। ফলে তাদের কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি শত্রু থাকে না। তেমনি বাউল রণেশেরও নির্দিষ্ট ব্যক্তি শত্রু নেই। তা তিনি নিজেও বলেছেন।
বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল যেমন বাউল সাধকদের পূন্যভূমি তেমনি এ অঞ্চলে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীরও দৌরাত্ম রয়েছে। যে দৌরাত্মের চিত্র মাঝেমধ্যেই দৃশ্যমান হয়ে উঠে। এরা ভাবনার নিগূঢ় শিক্ষা থেকে যোজন যোজন দূরে। তাই হিংস্র কান্ডই তাদের একমাত্র সম্বল। বাউল রণেশের গানের ঘর পুড়িয়ে দিয়ে সে হিংস্রতারই জানান দিয়েছে। বাউলের ঘর পুড়িয়ে দিলেও, বাউলের গানের পান্ডুলিপি পুড়িয়ে দিলেও, বাউলের বাদ্যযন্ত্র পুড়িয়ে দিলেও বাউলের সহজাত ভাবনাকে কি পুড়িয়ে দেয়া যায়? যায় না। তাই বলতে হয়;
পোড়াবি ঘর পোড়াবি পান্ডুলিপি
পোড়াবি একতারা পোড়াবি দোতরা
বাউলের ভাবনা কেমনে পোড়াবি
ওরে গন্ড মূর্খের দল?