মোহনগঞ্জে গৃহকর্মী হত্যা মামলায় চেয়ারম্যানকে বাঁচাতে ওসির ‘কারসাজি’

Date:

Share post:

কে. এম. সাখাওয়াত হোসেন : করোনাকালে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থানার ওসি মো. আবদুল আহাদ খান সিএনজি চালকের ফোন পেয়ে বাসায় খাবার পৌঁছে দেয়া, অসহায় ভিক্ষুকের ৭ দিনে খাবার দেয়া থেকে শুরু করে কৃষকের ধান কেটে দেওয়া এসব কারণে উপজেলাবাসীর কাছে খুবই মহানুভব মানবিক পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে কয়েক মাসের মধ্যেই স্বীকৃতি লাভ করেছেন। এবার তার বিরুদ্ধে গৃহকর্মীর রহস্যজনক মৃত্যুকে চেয়ারম্যানের যোগসাজশে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বারহাট্টা উপজেলার সিংধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক শাহ মাহবুব মুর্শেদ কাঞ্চনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তার নিজ গৃহে গৃহকর্মী মারুফা আক্তারকে (১৪) নির্যাতন করে হত্যা করার। সিংধা গ্রামের মৃত আকবর আলী স্ত্রী ও ভিকটিমের মা আকলিমা আক্তারের অভিযোগ লাশ দাফনের পূর্বে নিজ হাতে গোসলের সময় মেয়ের গলায় ও দেহের বিভিন্ন স্থানে নীল ফোলা জখমসহ গোপনাঙ্গে আঘাতের চিহ্ন পেয়েছেন।

আরো জানা যায়, ঘটনার দুদিন পর গত সোমবার (১১ মে) আকলিমা আক্তারকে অভিযোগ দায়ের কথা বলে ফোন করে থানায় নিয়ে আসা হয়। এরপর ওসির কক্ষে ওসি ও চেয়ারম্যান থানায় আটকে রেখে তাদের লিখিত কাগজে স্বাক্ষরের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। পরে সিংধা ইউনিয়নের সংরক্ষিত মহিলা (৩,৪,৫) আসনের সাবেক মেম্বার সন্ধ্যা রানী ৯৯৯ ফোন করে থানা থেকে বের হতে সাহায্য করেন।

স্থানীয় সাংবাদিক ও এনজিও স্বাবলম্বী’র দুই কর্মী ও ৯৯৯ সুবাধে তাদের উপস্থিতিতে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে থানা থেকে বের হন ভিকটিমের মা। পরে ওই দিন সন্ধ্যায় চেয়ারম্যানকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। পরে মঙ্গলবার দুপুরে চেয়ারম্যানকে আদালতে প্রেরণ করলে আদালত তাকে কারাগারে প্রেরণ করেন।

ঘটনার দুই দিন পর সোমবার (১১ মে) ইফতারের পর ওসিকে ফোন দিলে তিনি জানান জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চেয়ারম্যানকে আটক করা হয়েছে। এর আগে শনিবার (৯ মে) রাতে কারেন্টের তার পেঁচানো এক লাশ উদ্ধার করা হয়েছে এ তথ্যটি নিশ্চিত করেন।

ঘটনার দিন শনিবার (৯ মে) রাতে সিংধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক শাহ মাহবুব মোর্শেদ কাঞ্চন ফোনে বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। বিকেল ৪টায় বাসায় এসে গোসল করেছেন। এরপর মারুফাকে খোঁজাখুঁজি করে বাসার পিছনে বড়ই গাছে কারেন্টের তারে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে এ তথ্যটি জানান।

নিজ গৃহে গৃহকর্মীর লাশ চেয়ারম্যান নিজেই হাসপাতালে নিয়ে গেছেন সেখান কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। খবর পেয়ে পুলিশ হাসপাতালে যায়। লাশ হাসপাতালে বেশিক্ষণ না রেখে ময়না তদন্তের জন্য ব্যাগে ভরে অ্যাম্বুলেন্সে করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। ময়নাতদন্তের জন্য নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে না নিয়ে, কেন থানায় আনা হলো এমনই অভিযোগ স্থানীয়দের। ভিকটিমের মা, ভাই ও স্বজনদের অভিযোগ থানায় অ্যাম্বুলেন্সে রাখা লাশ সারা রাতের মধ্যে একবারের জন্য তাদেরকে দেখতে দেওয়া হয়নি।

অভিযোগের বিষয় নিয়ে মোহনগঞ্জ থানার ওসি মো. আবদুল আহাদ খানের সাথে মঙ্গলবার (১২ মে) বিকেলে কথা হলে তিনি বলেন, ধর্ষনের বিষয়টি ময়নাতদন্তের পর জানা যাবে। বিভিন্ন জায়গার আঘাতের চিহ্নের বিষয়ে বলেন, মামলা হয়েছে তদন্ত করছি আমরা। দুদিন পর আটকের ব্যাপারে বলেন, অভিযোগ পরে পেয়েছি। লাশ ভাই ও স্বজনদের না দেখানো বিষয়ে বলেন, হাসপাতাল তো পাবলিক স্থান। এখানে মানুষ সেবা নিতে আসে এবং একটা আতংক তৈরী হয়েছে। টিএইচও (উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্ত) বারবার ফোন করে লাশটি সরানোর জন্য। ওখানে মানুষজন চিকিৎসা নিতে আসতে ভয় পাচ্ছে। এজন্য আইও (তদন্ত কর্মকর্তা) এর হেফাজতে রেখে এম্বুলেন্সে রাখা হয়েছে। নিহতের মা আসছে রাত ২টার দিকে। এম্বুলেন্স খুলে দেয়া হয়েছে, তাদের অভিযোগ সঠিক নয়। রাতে তারা দেখবে না পরে সকালে দেখেছে। আমরা তো তার জন্য অপেক্ষ করলাম পরে সকালে ময়নাতদন্তের জন্য প্রেরণ করা হয়। পরে ঘটনার দিন রাতে ফোন দেয়া হলে আপনি আত্মহত্যা কথা বলেছিলেন এর উত্তরে বলেন প্রাথমিকভাবে এটা আত্মহত্যা মনে হয়েছিল। এখন অভিযোগ দিয়েছে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসা সাপেক্ষে তদন্ত করা হবে। ধামাচাপার বিষয়ে তিনি বলেন পুলিশ ধামাচাপা দিবে না এই বলে ধন্যবাদ জানিয়ে ওসি সংযোগ কেটে দেন।

নিহতের মা আকলিমা আক্তারের সাথে কথা বললে তিনি জানান, ‘দু’বছর আগে স্বামী প্রতিপক্ষের আঘাতে স্বামী খুন হওয়ার কয়েক মাস পরে চেয়ারম্যানের বাসায় কাজের জন্য আমার ছোট মেয়ে নেয়। প্রথমে দিতে চায়নি। পরে প্রতিবেশীদের অনুরোধে আর্থিক অবস্থা ও স্বামীর মামলা বিচারের ব্যয় বিবেচনা করে সম্মতি দেই। চেয়ার‌্যমান লেখাপড়া ও বিয়ে দেয়ার আশ্বস্থ করে মেয়েকে মোহনগঞ্জ পৌরসভার দৌলতপুর এলাকায় নিজস্ব বাসায় নিয়ে যায়। এদিকে সংসার ও ছেলের লেখাপড়া খরচ যোগাতে আজ থেকে দেড় মাস আগে ঢাকায় এক বাসায় কাজে যায়। গত শনিবার (৯ মে) বিকেলে ফোনে জানায় আমার মেয়ে একসিডেন্ট করে হাসপাতালে। পরে আমি চেয়ারম্যানের বউকে ফোন দিলে তিনি ধরেননি। পরে আবার দিলে ফোন বন্ধ পায়। চেয়ারম্যানের ভাতিজা ফেরদৌস ফোন দিয়ে বলে হাসপাতালে আছে। আমার কান্না দেখে যে বাসায় কাজ করি সে ম্যাডাম আমার ছেলে ও ভাগ্নিনাকে ফোন দেয় এবং কিভাবে পাঠানো যায় তা নিয়ে ম্যাডাম চিন্তা করতে থাকে। পরে চেয়ারম্যানের ছেলে তন্ময় ফোন করে জানায় গাড়ী নিয়ে আসতেছি এলাকায় নিয়ে যাবার কথা বলে। তার সাথে রওনা দিয়ে আসার পথে আমার ছেলে আকিকুল ও ভাগিনা ফোনে জানাই লাশ দেখতে দিচ্ছে না পুলিশ। চেয়াম্যানের ছেলে কাকে যেন ফোন দেয় বলে ওসি কথা বলবে। পরে ওসি বলে আপনি নেত্রকোনায় থাকেন লাশ পোষ্ট মোর্ডামের জন্য নেত্রকোনা পাঠানো হয়েছে। আমি লাশ এখনও দেখিনি, না দেখে কিসের পোষ্ট মোর্ডেম।

রাতে থানায় আসলে লাশ দেখতে পায়নি। আইও (তদন্ত কর্মকর্ত) লিখিত কাগজ এনে আমাকে বলে চেয়ারম্যান সই করেছে তুমি কর। আমি বলি ছেলে ও ভাগিনা পড়ে না শুনালে আমি সই করব না। আগে আমি স্বামীর খুনের মামলায় সই করে এখন এই মামলা হালকা হয়ে গেছে। আমি করব তবে দেখে শুনে করব। সকালে আমাদেরকে এম্বুলেন্সে করে নেত্রকোনায় পাঠায় এবং এম্বুলেন্সেই দেখতি পায় মেয়ের দেহে বিভিন্ন ফোলা জখমের দাগ। মোবাইলে ছবি তুলে রাখি। পোষ্ট মোর্ডেমের পরে দাফনের আগে গোসল আমি নিজেই করাই। তখন আরো দেখতে পায় শরীরের অনেক স্থানে কালো ফোলাসহ গোপনাঙ্গে আঘাতে চিহ্ন। রবিবার (১০ মে) ওসি আমাকে ফোন করে বলে আগামী কাল থানায় আসেন অভিযোগ দিতে। সিএনজি ভাড়া দিয়ে দিয়ে দেয়া হবে।

পরের দিন সোমবার (১১ মে) মেম্বার সন্ধ্যা রানীকে জানিয়ে ১১টি দিকে থানা আসি। আসলে ওসি ও চেয়ারম্যান বসে আছে। আইও লিখিত কাগজ নিয়ে এসে বলে সই করার কথা। আমি বলি আগে মামলা করে ঠকেছি। এবার মামলা আমি করবো তবে নিজেদের লোক দিয়ে অভিযোগ লিখে। তারা বাববার সই করার জন্য চাপ দিতে থাকে। থানা থেকে বের হয়ে আসতে চাইলে মহিলা পুলিশ দিয়ে আটকে রাখে। ওই দিন বিকেলে সন্ধ্যা রানী আমাকে ফোন দিয়ে দেরী কেন জানতে চাইলে বলি আমাকে থানা থেকে বের হতে দিচ্ছে না সই নিতে চাচ্ছে। কোথাও সই দিতে না করে সন্ধ্যা রানী। এ সময় আমার হাত থেকে মোবাইলটি থাপা দিয়ে দিয়ে যায়। সন্ধ্যা রানীকে জিডি ও মামলার ভয় দেখায় ওসি’।

এ বিষয়ে সিংধা ইউনিয়নের সাবেক সংরক্ষিত (৩,৫,৬) মহিলা মেম্বার সন্ধ্যা রানীয় রায় জানান, আকলিমা আমার সাহায্য নেয়ার জন্য এসেছিল। সোমবার থানায় অভিযোগের জন্য যেতে বলেছে একথা বলে সে থানায় চলে যায়। তার আসতে দেরি দেখে বিকেলে মোবাইল করি। সে আমাকে বলে পুলিশ নাকি তাকে আটকে রেখেছে ওসি ও চেয়ারম্যান স্বাক্ষরের জন্য চাপ প্রয়োগ করছে। আমি তাকে বলি কোন কাগজে স্বাক্ষর করিও না। এ অবস্থায় ওসি ওর কাছ থেকে মোবাইলটা নিয়ে আমার সাথে কথা বলে এবং আমাকে জিডি ও মামলার ভয়-ভীতি দেখায় ওসি। আমি ৯৯৯ ফোন করে সাহায্য নেই। পরে অভিযোগ দায়ের করে আকলিমা থানা বের হয়।

নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) মো. একরামুল হাসান জানান, সকল আলামত রাখা হয়েছে। এছাড়া ডিএনএ টেষ্ট করতে পুলিশকে বলা হয়েছে। সবগুলো রিপোর্ট আসলে বলা যাবে।

এ ব্যপারে বুধবার (১৩ মে) বিকেলে নেত্রকোনার পুলিশ সুপার আকবর আলী মুনসী’র সাথে কথা হলে তিনি জানান, কেউ থানা থেকে অন্যায় আচরন পেয়েছেন তিনি অভিযোগ করতেই পারেন। আমরা দেখতেছি আউটকাম। তিনি (অভিযোগকারী) মামলা রুজু করতে চেয়েছেন। মামলা রুজু হয়েছে। বাকী বিষয়টা আমরা তদন্ত করে বের করবো। ধর্ষণের বিষয়ে বলা হচ্ছে তাই ডিএনএ প্রোপাইল রেখে ফরেনসিক মতামতের জন্য ঢাকায় পাঠাচ্ছি। আমাদের তরফ থেকে কোনা কার্যক্রম বাকি রাখা হচ্ছে না। এরপর তদন্ত সাপেক্ষে কতটুকু ন্যায় বিচার দিতে পেরেছি। আসামী গ্রেফতার হয়েছে। সবগুলো বিষয়ই খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে তিনি জানান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

Related articles

সড়ক দূর্ঘটনায় পূর্বধলার মেধাবী ছাত্র তানভীর নিহত

পূর্বধলা প্রতিনিধিঃ স্বপ্ন দেখতেন একদিন অনেক বড় হবেন। বাবা-মা দেশের মুখ উজ্জ্বল করবেন। ছিলেন প্রচণ্ড পরিশ্রমী...

পূর্বধলায় যৌথ অভিযানে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার, আটক ৫

শিমুল শাখাওয়াতঃ নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার জালশুকা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ম্যাগজিনসহ একটি নাইন এমএম পিস্তল উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনীর...

পূর্বধলায় মাছ ধরা কে কেন্দ্র করে নিহত ১

মোঃ শাখাওয়াত হোসেন শিমুলঃ নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের মেঘশিমুল পশ্চিমপাড়া গ্রামে গতকাল শুক্রবার বিকেলে এ ঘটনাটি ঘটে। নিহত...

পূর্বধলায় শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী পালিত

মোঃ শাখাওয়াত হোসেন শিমুলঃনেত্রকোনার পূর্বধলা সার্বজনীন পূজা মন্দির এর উদ্যোগে সোমবার পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী শোভাযাত্রা ও আলোচনা...