চিরায়ত চিকিৎসা: স্বাস্থ্যপর্যটনের নতুন দিগন্ত
মোখলেছুর রহমান
ভূমিকা:
নাটোরের ৩টি ইউনিয়নে প্রায় ৫,০০০ কৃষক ২২ প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদ চাষ করেন। এই তথ্যটিকে পুঁজি করে ট্যুর অপারেটররা ঐ স্থানে হোমস্টে ও স্থানীয় গাইডিংয়ের ব্যবস্থা করলে “ট্র্যাডিশনাল মেডিসিন ট্যুর” নামে স্বাস্থ্য পর্যটনের একটি প্যাকেজ সহজেই তৈরি করে ফেলতে পারবে। আবার এখন করোনাকালীন সংকটে যখন ঐ স্থানে ১৫০ হেক্টর জমির প্রায় ১৫ কোটি টাকার উদ্ভিদ ইতোমধ্যে নষ্ট হয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদের প্রেক্ষিতে “রিয়েলিটি ট্যুরিজম” নামে আরেকটি প্যাকেজ তৈরি করে এসব ক্ষতি ও সর্বনাশ দেখিয়ে অর্থ ও সুনাম দুটোই অর্জন করতে পারবে। আর আবদুল গণি (১৯৮৮) লিখিত বাংলাদেশের ঔষধি উদ্ভিদ বইয়ের বরাত দিয়ে যদি প্রচার করা যায় যে, বাংলাদেশে ৪৪৯ প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদ আছে, তাহলে অন্য দেশ থেকে ঔষধি উদ্ভিদ নিয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণা করেন এমন অনেক মানুষ ছুটেও আসতে পারেন। তাতে কিছু বৈদেশিক মুদ্রা কামাই করে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু এই অর্থ উপার্জনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এইসব জীবন রক্ষাকারী ঔষধি উদ্ভিদ সুরক্ষার জন্য শিঘ্রই ব্যবস্থা গ্রহণ করা, না হলে করোনার মতো আরেকটি মানবিক পরাজয়ের জন্য আমাদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থ্য প্রায় দেড় যুগ আগে এক গবেষণায় ভবিষ্যৎ বাণী করেছে যে, বিপন্নপ্রায় উদ্ভিদগুলিকে সুরক্ষা না করতে পারলে আগামী দিনে ঔষধ তৈরির কাঁচামালের অভাবে মানুষ মুত্যুবরণ করবে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতিটি রাজ্যে একটি করে মেডিসিনাল প্ল্যান্ট বোর্ড আছে এবং দিল্লীতে আছে ন্যাশনাল প্ল্যান্ট বোর্ড। আমাদের দেশে বাংলাদেশ মেডিসিনাল প্ল্যান্ট বোর্ড করার চিন্তা করা হলো ২০১১ সালে, অথচ তা আলোর মুখ দেখলো না। নিশ্চয়ই এর দায় কোন আমলা কিংবা মন্ত্রী কেউই নিবেন না।
চিরায়ত চিকিৎসা কী?
দেশজ যে চিকিৎসা পদ্ধতি (Indigenous Medicine) স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অর্থাৎ শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায়, রোগ নির্ণয়ে এবং চিকিৎসা পরিচালনায় ব্যবহৃত হয় তাকে চিরায়ত চিকিৎসা পদ্ধতি বলে। লোকজ জনজীবন থেকে উঠে আসার জন্য একে লোকজ চিকিৎসাও বলা হয়। এই চিকিৎসাশাস্ত্র তত্ত¡, বিশ^াস ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সৃষ্টি ও অনুশীলন করা হয় বলে অনেকে একে বিকল্প চিকিৎসা বলেও অভিহিত করেন। অন্যদিকে আদিবাসি সম্প্রদায় তাদের নিজেদের উদ্ভাবিত ভিন্ন চিরায়ত চিকিৎসা পদ্ধতিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা করেন, একে Ethno-medicine বলে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) প্রত্যেকটি চিরায়ত চিকিৎসা পদ্ধতিকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে অধ্যয়নের, সংরক্ষণের তাগিদ দিয়ে জনজীবনের এদের প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত করেছে। সম্প্রতিকালে Ethno-medicine-এর অনুসন্ধান এবং যথাযথভবে নথিভূক্ত করার জন্য WHO অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। বাংলাদেশ ব্যতীত আমাদের সকল প্রতিবেশি দেশে এসব বিষয়ের উপর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে।
প্রতিটি দেশ বা অঞ্চলের মতো আমাদেরও রয়েছে হাজার হাজার বছরের প্রাচীন চিরায়ত চিকিৎসা পদ্ধতি যা তৎকালীন জ্ঞানী, দার্শনিক ও চিকিৎসকগণ উদ্ভাবন করেছেন। একটি উদাহরণ দিলে পরিস্কার হবে। প্রাচীন ভারতে খ্রিস্টপূর্ব ২ শতক থেকে ১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ১,৩০০ বছর ধরে মানব চিকিৎসায় বিভিন্ন খনিজ পদার্থের ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য গবেষণা চলেছে, যাকে ভারতীয় আলকেমি বলে চিহ্নিত করা হয়। এইসব উদ্ভাবনী আজ আমাদের চিরায়ত চিকিৎসার ভিত্তি। প্রাচীন পন্ডিতগণ অভূতপূর্ব অবদান রেখে গেছেন অঞ্চলের চিকিৎসা ব্যবস্থায়। গবেষকগণ বলছেন যে, সারা পৃথিবীতে অঞ্চলভেদে ৬০-৮৫% মানুষ এখনো তাদের চিরায়ত চিকিৎসা পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল। উল্লেখ্য, এখনো চীন, ভারত, জাপান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, কোরিয়ার কমপক্ষে ৪০% মানুষ তাদের চিরায়ত চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগ নিরাময় করে। বাংলাদেশের অবস্থান জানা না গেলেও এটুকু জানা যায় যে, এখানে ২৩২টি আয়ুর্বেদিক ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে ঔষধ উৎপাদন করছে। অর্থাৎ এ থেকে চাহিদার একটি তথ্যচিত্র পাওয়া যায়।
আমাদের চিরায়ত চিকিৎসা কোনটি:
প্রাচীন ভারতে প্রায় ৫,০০০ বছর আগে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার গোড়াপত্তন ঘটে এবং ৫,০০০ বছর আগে উত্তর-ভারতের ইন্দাজ-সরস্বতী সভ্যতায় যোগ দর্শনের (Yoga Philosophy) সুচনা হয়, যা ১৯ শতকের শুরুতে আধুনিক যোগবিদ্যায় রূপলাভ করে। গ্রীস থেকে ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতির জন্ম হয়। Aesculapius এই চিকিৎসা পদ্ধতির জনক। চীনে জন্ম নেয় ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিনের। আর জার্মান থেকে জন্ম হয় হোমিওপ্যাথির। বাংলাদেশে এর সবগুলিই কমবেশি অনুশীলন হচ্ছে। অধিকন্তু চাকমা, মারমা, রাখাইন, টিপরা, গারো, খাসিয়া প্রভৃতি আদিবাসিদের রয়েছে নিজস্ব Ethno-medcine। ইউনেস্কো যে কোন চিরায়ত চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ঐ জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্য বলে ঘোষণা করেছে। কেননা, চিরায়ত চিকিৎসা ব্যবস্থা একটি জাতিগোষ্ঠীকে কেবল সুস্থ্যই রাখে না, বরং তার সংস্কৃতির অংশ। তাই সময় এসেছে দেশে যত ধরণের চিকিৎসাই থাকুক, আমাদের চিরায়ত চিকিৎসাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দানের। এর ফলে আমাদের চিকিৎসা বিষয়ক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পৃথিবীর মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারবো। এর বিষদ অধ্যয়ন, গবেষণা, অনুশীলন এবং সংরক্ষণের একটি পরিপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে। তা না হলে আমরা হারিয়ে ফেলবো জাতীয় জীবনের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে।
উদ্ভিদভিত্তিক চিরায়ত চিকিৎসা:
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশে হাজার হাজার বছর আগে থেকে উদ্ভিদভিত্তিক চিরায়ত চিকিৎসার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। আমাদের প্রচীন পন্ডিতগণ দীর্ঘ বছরের গবেষণার মাধ্যমে চিকিৎসায় উদ্ভিদের সুনির্দিষ্ট ব্যবহার এবং প্রটোকল নিধারণ করেছেন। তরল, ক্বাথ, পাউডার ও গুটিকা – এই ৪ (চার) আকারে উদ্ভিদের ব্যবহারবিধি প্রবর্তন করেছেন তারা। অনুজীবঘটিত সংক্রামক রোগ, খাদ্যবাহিত রোগ, কানের রোগ, মুত্রতন্ত্রের সংক্রামন এবং যৌন রোগেও চিকিৎসাতেও এই অঞ্চলে উদ্ভিদের ব্যবহার অতি প্রাচীন। চর্মরোগ, সাইনুসাইটিসসহ কত রোগ নিরাময়ের জন্য উদ্ভিদ ব্যবহৃত হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। বংশপরম্পরায় উদ্ভিদভিত্তিক চিরায়ত চিকিৎসা এখানে মূর্তমান। আজকাল রসায়নবিদগণ উদ্ভিদ থেকে একলালয়েড, গøাইকোসাইড, ফ্ল্যাভোনয়েড, টেনিন, তারপিন, রেজিন, গাম, মিউসিলেজ, এন্টি-অক্সিডেন্ট ইত্যাদির অনুসন্ধান করে উদ্ভিদকে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে যুক্ত করছেন। তাতে উদ্ভিদের ঔষধি ব্যবহার বেড়েছে বটে, কিন্তু সিনথেটিক ঔষধ প্রস্তুত করতে গিয়ে উদ্ভিদের এন্টিডট প্রপার্টি ফেলে শুধু ডট গ্রহণ করার জন্য ঔষধে পার্শপ্রতিক্রিয়া বেড়ে গেছে। উল্লেখ্য, ডট ও এন্টিডট উভয় বৈশিষ্ট্য একটি ঔষধি উদ্ভিদে থাকে এবং চিরায়ত চিকিৎসা পদ্ধতিতে উদ্ভিদের এই সকল বৈশিষ্ট্য অবিকৃতভাবে ব্যবহার করা হয় বলে তাতে পার্শপ্রতিক্রিয়া প্রায় অনুপস্থিত থাকে।
চিরায়ত চিকিৎসায় বাংলাদেশ
আধুনিক অর্থনীতির মাপকাঠিতে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে স্থান পেয়েছে, যার প্রায় ৮০% মানুষ এখনো গ্রামে বাস করেন। শহরের তুলনায় বিশেষজ্ঞ এলোপ্যাথিক চিকিৎসকদের স্বল্পতা, হাসপাতালের অব্যস্থাপনা, চিকিৎসার উচ্চব্যয় এবং ব্যাধি নিরাময় ও জরা ব্যবস্থাপনায় এলোপ্যাথিক ডিসিপ্লিনে কোন চিকিৎসা না থাকায় গ্রামের মানুষ জনস্বাস্থ্য নিয়ে বেশ বিপাকে আছেন। ফলে তাদেরকে বাধ্য হয়ে অশিক্ষিত ও অনভিজ্ঞ স্থানীয় লোকজ চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হন। অথচ আমরা শিক্ষিত কবিরাজ (বা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক) তৈরি করতে পারলে এই সংকট সৃষ্টি হতো না। তাই এখন সময় এসেছে ডিগ্রিধারী কবিরাজ তৈরি করার। আমাদের মেধাবী তরুণদেরকে এই চিরায়ত চিকিৎসার উপর ডিগ্রি প্রদান করে তাদেরকে বর্তমান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে পদায়ন করতে পারলে দেশে জনস্বাস্থ্যের একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন হতো। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে শত শত মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হয়েছে। অথচ আয়ুর্বেদে ডিগ্রি দেওয়ার জন্য ঢাকায় একটি মাত্র সরকারি কলেজ ছাড়া কেন আর কোন কলেজ হলো না এর কোন উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটি আমাদের চরম দীনতা। তাই এই দীনতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিচের কাজগুলি করতে হবে-
– বাংলাদেশে অন্তত একটি সরকারি আয়ুর্বেদিক বিশ^বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে এবং এই বিশ^বিদ্যালয়ের অধীন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রচুর পরিমাণে আয়ুর্বেদিক ডিগ্রি কলেজ স্থাপন করতে হবে।
– ইয়োগা শিক্ষাকে দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য দেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ইয়োগা ডিগ্রি কলেজ স্থাপন করতে হবে।
– মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের অনুরূপ আয়র্বেদিক ও ইয়োগা কাউন্সিল গঠন করতে হবে।
– চীনা মেডিক্যাল শিক্ষা ব্যবস্থা আদলে আমাদের এমবিবিএস পর্যায়ে চিরায়ত চিকিৎসার অন্তত এক-পঞ্চমাংশ কোর্স যুক্ত করতে হবে।
– অবিলম্বে বাংলাদেশ মেডিসিনাল প্ল্যান্ট বোর্ড স্থাপন করতে হবে যারা ঔষধি উদ্ভিদের গবেষণা, জরিপ, সংরক্ষণ, উৎপাদন, চাহিদা নিরূপণ এবং আমদানি-রপ্তানি নীতিমালা তৈরি করবে।
– বাংলাদেশ মেডিসিনাল প্ল্যান্ট বোর্ডের অধীন একটি জার্মপ্লাজম সেন্টার / জিন ব্যাংক এবং একটি হারবেরিয়াম স্থাপন করতে হবে।
– এথনো-মেডিসিন জরিপসহ তাদের চিকিৎসা পদ্ধতি যথাযথভাবে নথিভূক্ত করতে হবে।
– সরকারি হর্টিকালচার কেন্দ্র এবং বন বিভাগের চারা উৎপাদন কেন্দ্রগুলিকে কাঙ্খিত প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদের চারা উৎপাদনের নির্দেশ দিতে হবে।
– কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে কৃষক পর্যায়ে ফসল চাষের পাশাপাশি ঔষধি উদ্ভিদ চাষের প্রযুক্তি সম্প্রসারণের দায়িত্ব দিতে হবে।
– বন অধিপ্তরকে বনজ ঔষধি উদ্ভিদ সংরক্ষণ, কমিউনিভিত্তিতে চাষ এবং তা বৈজ্ঞানিক উপায়ে সংগ্রহের দায়িত্ব দিতে হবে।
– জেলা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিকে সঙ্গে নিয়ে ঔষধি উদ্ভিদের ব্যবসায়ীদেরকে সংগঠিত করতে হবে।
– আয়ুর্বেুদিক ঔষধ উৎপানের কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
– প্রতিটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, উপজেলা হসপিটাল, জেলা হসপিটাল এবং প্রত্যেকটি মেডিক্যাল কলেজ হসপিটালি আয়ুর্বেদ ও ইয়োগা ডিগ্রিধারী চিকিৎসক পদায়ন করতে হবে।
– মানুষের মধ্যে গণসচেতনতা সৃষ্ঠির জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।
চিরায়ত চিকিৎসার স্বাস্থ্যপর্যটন
চিরায়ত চিকিৎসায় চীন ও ভারত সবচেয়ে এগিয়ে আছে বলে চিরায়ত চিকিৎসা স্বাস্থ্যপর্যটনেও এরা প্রথম সারিতে। ভারত আয়ুর্বেদ, ইয়োগা, সিদ্ধা ও ন্যাচারোপ্যাথি প্রভৃতিকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গুরুত্ব দিয়ে AYUSH নামে আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন করেছে। আমরা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই জাতীয় সিদ্ধান্ত করতে পারি কিনা, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। চিরায়ত চিকিৎসাভিত্তিক স্বাস্থ্যপর্যটনকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে অন্তত নিচের ১০ (দশ)টি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
ক) ঔষধি গ্রাম (Medicinal Plants Village): নাটোরের ৩টি ইউনিয়নে অবস্থিত ঔষধি গ্রামগুলিতে পর্যটকরা ভ্রমণে গেলে ২২ প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদের উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, সংগ্রহ, সংরক্ষণ পদ্ধতি ও বিক্রয় ক্ষেত্রগুলি স্বচক্ষে দেখতে পাবেন। হোমস্টেতে রাত্রিযাপনকালে প্রয়োজনীয় ওয়েলনেস ট্রিটমেন্ট গ্রহণ করতে পারবেন। নিজেদের পারিবারিক স্থাস্থ্য রক্ষায় কিছু টিপস্ এবং উদ্ভিদের পাতা, ফুল, কুঁড়ি, ছাল, ফল, মূল, বীজ, উদ্ভিদের কস, আঠা ইত্যাদি ব্যবহার করে গার্হস্থ্য চিকিৎসা কিছু কৌশল শিখতে পারবেন। জলচিকিৎসা, মধু দিয়ে কত রকমের চিকিৎসা হয় সে সব বিষয় সম্বন্ধে জানতে পারবেন।
খ) আয়ুর্বেদিক রিসোর্ট (Ayurvedic Resort): বাংলাদেশে অবস্থিত ৫ শতাধিক রিসোর্ট এবং শতাধিক থিম ও এমিউজমেন্ট পার্কে ভ্রমণকালীন সময়ে পর্যটকরা পঞ্চকর্ম চিকিৎসা, আয়ুর্বেদিক স্পাসহ অন্যান্য রোগের চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারবেন। আয়ুর্বেদ মতে তারা বডিটাইপ নির্ধারণ করিয়ে সে মতো ডায়েটের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবেন। তারা আরও জেনে নিতে পারবেন আয়ুর্বেদিক রেসিপি ও রান্নার পদ্ধতি। এসব বিষয় পর্যটকদেরকে মুগ্ধ করবে।
গ) জার্মপ্লাজম সেন্টার (Germplasm Center): বাংলাদেশের ঔষধি উদ্ভিদের সকল প্রজাতি সংগ্রহ করে একটি জার্মপ্লাজম সেন্টার স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি। এই সেন্টার ঔষধি উদ্ভিদ চাষীদেরকে চারা সরবরাহ করতে সাহায্য করবে। পর্যটকরা এই সেন্টার পরিদর্শনকালে ঔষধি উদ্ভিদের পূর্ণ সংগ্রহশালা দেখে মুগ্ধ হবেন এবং জ্ঞান অর্জন করবেন। বিশেষত ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষকদের জন্য এই সেন্টার বড় বিদ্যাপিঠ হিসেবে কাজ করবে।
ঘ) আয়ুর্বেদিক হসপিটাল (Ayurvedic Hospital): জেনারেল হসপিটালগুলির মতো আয়ুর্বেদিক হসপিটালেও হাজার হাজার দেশি-বিদেশি মানুষ চিকিৎসা গ্রহণের জন্য মেডিক্যাল ট্যুরে আসবেন। বিশেষত আর্থ্রাইটিস, চর্মরোগ, যৌনরোগ, শিশুরোগ এবং নারীদের নানাবিধ রোগের চিকিৎসার জন্য আয়ুর্বেদিক হসপিটাল হতে পারে চিকিৎসার নির্ভরযোগ্য স্থান।
ঙ) আয়ুর্বেদিক চক্ষু হসপিটাল (Ayurvedic Eye Hospital): কেরালায় তৈরি হয়েছে শ্রীধারীয়াম আয়ুর্বেদিক আই ক্লিনিক এন্ড পঞ্চকর্ম সেন্টার নামক ৩৫০ বেডের ISO সার্টিফাইড বিশাল হসপিটাল। আমরা বাংলাদেশেও অনুরূপ হসপিটাল স্থাপন করতে পারি। এই হসপিটালে অন্তত ২৪টি দূরারোগ্য চক্ষুরোগের চিকিৎসা প্রদান করা যাবে। তাই আশা করা যায় এই জাতীয় হসপিটালে দেশি ও বিদেশি প্রচুর সংখ্যক রোগী চিকিৎসার জন্য আসবেন যেমন আসেন শ্রীধারীয়ামে।
চ) আয়ুর্বেদিক জেরিয়াটিক ম্যানেজমেন্ট হসপিটাল (Ayurvedic Geriatic Management Hospital): বয়স্ক মানুষ জরাব্যাধিতে আক্রান্ত হবেন এটি স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক বিষয় হলো এদের কোন বিশেষায়িত জেরিয়াটিক হসপিটাল নাই। বাংলাদেশে এই ধরণের আয়ুর্বেদিক জেরিয়াটিক ম্যানেজমেন্ট হসপিটাল স্থাপন অত্যন্ত জরুরি। দেশি এমনকি প্রচুর বিদেশি সিনিয়র সিটিজেনরা ছুটে আসবেন এই হসপিটালে চিকিৎসা গ্রহণ করার জন্য।
ছ) আয়ুর্বেদিক ক্যান্সার হসপিটাল (Ayurvedic Cancer Hospital): ডি এস রিসার্চ সেন্টার নামক আয়ুর্বেদিক ক্যান্সার চিকিৎসা হসপিটালের ৬টি শাখা রয়েছে কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন অংশে। এখানে গ্রেড ১ ও গ্রেড ২ ক্যান্সার রোগীরা সহজেই নিরাময় লাভ করেন। গ্রেড ৩-র অনেক রোগী ভালো হচ্ছেন। বিষয়টি অবিশ^াস্য হলেও সত্য। আয়ুর্বেদে এতো বিস্ময়কর ঔষধ রয়েছে ক্যান্সার চিকিৎসায়, যা না দেখলে বিশ^াস করতে কষ্টই হবে। আমাদের এখানে এইজাতীয় হসপিটাল স্থাপন করতে পারলে তা দেশি বিদেশি ক্যান্সার রোগীদেরকে টেনে আনবে।
জ) যোগ সেন্টার (Yoga Center): পতঞ্জলি মুনি ৮ম শতকে পৃথিবীর মানুষকে যোগ দর্শন দিয়ে এতটাই সমৃদ্ধ করে গেছেন যে, তা আজ সারা পৃথিবীতে সমাদৃত। যোগ বিষয়ক ডিগ্রি, মাস্টার্স ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে ভারতের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সাধারণ মানুষ যোগ অনুশীলনে শারীরিক ও মানসিকভাবে উপকৃত হচ্ছেন। অর্থাৎ মনোদৈহিক রোগ নিরাময়ে যোগ আজ সর্বজনীনতা পেয়েছে। বাংলাদেশে যোগ বিষয়ত ডিপ্লোমা, ডিগ্রি, সার্টিফিকেট কোর্স এমনকি সাধারণ প্রশিক্ষণের আওতায় এনে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় একে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা যায়। বিশ^ব্যাপী জনপ্রিয় যোগকে আমাদের অন্যতম চিরায়ত চিকিৎসা হিসেবে স্বীকৃতি ও সম্মান দেখানো অত্যন্ত জরুরি।
ঝ) আয়ুর্বেদিক সেনিটারিয়াম (Ayurvedic Sanitarium): আমেরিকায় সেনিটারিয়াম শতবছর ধরে জনপ্রিয়। সেনিটারিয়াম হলো হোটেল ও হসপিটালের সমন্বিত পর্যটন আবাসন। পশ্চিমা সেনিটারিয়ামকে আয়ুর্বেদিক ধারায় পরিচালনা করতে পারলে এই ধরণের সেনিটারিয়াম বিত্তবান দেশীয় বয়জেষ্ঠ্য মানুষ এবং বিদেশিদের কাছে বেশ কদর পাবে।
ঞ) আয়ুর্বেদিক বিউটি পার্লার (Ayurvedic Beauty Parlour): বিভিন্ন উদ্ভিদের পেস্ট, রস, ক্বাথ, মধু এবং নানাবিধ খনিজ পদার্থ ব্যবহার করে গড়ে তোলা যায় আয়ুর্বেদিক বিউটি পার্লার যেখানে নারী এবং পুরুষ উভয়েই নিরাপদে নিজেদের সৌন্দর্য রক্ষার জন্য ফেসিয়াল, চুলের ট্রিটমেন্ট, আয়ুর্বেদিক ডায়েট চার্ট ইত্যাদি সেবা পাবেন। এই জাতীয় বিউটি পার্লার প্রাকৃতিকভাবে রূপচর্চা ও সৌন্দর্য অনুশীলনে সব শ্রেণির মানুষকে আকৃষ্ট করবে।
সারকথা:
এটিই সত্য যে, কেবল ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকঘটিত সংক্রামক রোগ এবং অপারেশন ছাড়া অন্য কোন রোগের মুক্তি মিলবে না এলোপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থায়। ফলে শত শত ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভের জন্য অথবা সহনীয় পর্যায়ে রেখে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ও যোগ অনুশীলনের দিকে ফেরত যাওয়ার কোন বিকল্প নাই। এমতাবস্থায় দেশি ও বিদেশি পর্যটকদেরকে আমাদের চিরায়ত চিকিৎসার দিকে নিঃসন্দেহে আকর্ষণ করা সম্ভব। অধিকন্তু, আয়ুর্বেদের ছাত্র-শিক্ষক, অন্যান্য শিক্ষার্থী, দেশি-বিদেশি গবেষক, ঔষধ প্রস্তুতকারী ব্যক্তিবর্গ, চিকিৎসা গ্রহণকারী, ওয়েলনেস সেবাপ্রার্থী, ঔষধি উদ্ভিদের ক্রেতা, সাধারণ দর্শনার্থী এবং ভ্রমণকারীরা এই সেবা গ্রহণ করতে আসবেন। এতে করে পর্যটন বাংলাদেশে স্বাস্থ্য শৃঙ্খলা ফেরত আনবে, জিডিপিতে অতিরিক্ত কয়েক হাজার কোটি টাকার অবদান রাখবে, বহির্গামী স্বাস্থ্যপর্যটন রোধ করে আরো কয়েক হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাবে এবং পর্যটন রপ্তানির মাধ্যমে আরো কয়েক শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবে। তাই সময় এসেছে পর্যটনের বহুমুখিতা ও সৃজনশীলতা নিয়ে কাজ করার।