“অন্তহীন মেহনতে বেঁকে গেছে যাদের পিঠ,
যারা উদ্ধত ভ্রুকুটির সামনে মাথা নত করেছে।
তারা জেগে উঠবেই, আমি জানি:
পর্বত সরে যাবে মাথা নীচু করে
আশার ডানায় ভর করে তারা উঠবে সবার উপরে।”
এক
ইতিহাস প্রসংগ
মহান মে দিবস। বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সংহতি এবং উৎসবের দিন হিসেবে উদযাপিত হয়। মে দিবসের পেছনে রয়েছে শ্রমিক-শ্রেণির আত্মদান ও বিরোচিত সংগ্রামের ইতিহাস। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ইউরোপে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। সেটি ছিল পুঁজিবাদী বিকাশের প্রাথমিক যুগ। তখন শ্রমিকদের কাজের কোনো শ্রমঘণ্টা নির্ধারিত ছিল না। ছিল না ন্যূনতম মজুরির নিশ্চয়তা।
যুক্তরাষ্ট্রে স্বতঃস্ফূর্ত ও অসংগঠিতভাবেই অনধিক ১০ ঘণ্টার শ্রমঘণ্টা নির্ধারণ ও অন্যান্য দাবিতে কয়লা খনি শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন শুরু করে। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে পেনসেলভেনিয়ার কয়লা খনি শ্রমিকদের সংঘর্ষে ১০ শ্রমিক নিহত হন।
দুই
‘যে দিন আমার ঘরে উনুন জ্বলে না,
সেদিন আমার পেট জ্বলে’…
আমি ‘মে দিবস’ বলছি…..
একমাত্র আমিই মনে রাখি একটি শ্রমিকের কান্না…
’যে দিন আমার ঘরে উনুন জ্বলে না,
সেদিন আমার পেট জ্বলে’…
আমিই হলাম সেই ‘মে দিবস’……
১৮৮৬ সালের আগেও ১লা মে ছিল ; কিন্তু তা অন্য দশটা সাধারণ দিনের মতোই…..।
১৮৮৬ সালের আগে শ্রমিক দের অবস্থা কেমন ছিল?..না কোন প্রশ্ন নয়…কোন জিজ্ঞাসা নয়..তা ইতিহাস…
আসুন আজ আমি ‘মে দিবস’ এক জন মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি..সেই মানুষটির নাম ‘শ্রমিক’।
তিন
‘মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে..
যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
……….অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।’
‘আমরা যে মানুষ নামে কোন প্রাণী তা কেউ ভাবতো না….তারা পশু ও শ্রমিককে এক ভাবতো…’
আমি ‘শ্রমিক’ বলছি…….
১৮৮৬ সালের আগে আমাদের প্রতিদিন কাজ করতে হত দৈনিক ১৬ ঘন্টা…
আমরা যে মানুষ নামে কোন প্রাণী তা কেউ ভাবতো না….তারা পশু ও শ্রমিককে এক ভাবতো…..
ও আমি ভুলে গিয়েছি তাদের সাথে পরিচয় করাতে আমি ভুলেই গেছি….তারা হলেন মহান…তারা আমাদের প্রভু,আর আমরা দাস.. তারা আমাদের মালিক……….
কিন্তু আমার আর কত দিন তা সহ্য করবো ….আমরা প্রতিবাদ করে এই পাশবিক অত্যাচারের….
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে হে মার্কেটে আমারা মিলিত হই মিছিল করে এই দিনেই (মে দিবস)।
একত্রিত হয়ে আমরা শ্লোগান তুলি ‘পুঁজিবাদের কালো হাত ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও’…
দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের দাবি মানতে হবে……মানতে হবে………..
আমরা সমবেত হই আগস্ট স্পীজ নামে এক জন মহান নেতার নেতৃত্বে……
এই একত্রিত সমাবেশকে আমাদের প্রভুরা ভয় পান……এতটাই দৃপ্ত শ্লোগান যে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন তারা…
তাদের পুলিস গুলি চালায়…সাথে সাথে ১১ জন আমরা (শ্রমিকেরা)প্রাণ দিই…১৮৮৬ সালের ১লা মে দিনে।
চার
‘আজ আমাদের এই নি:শব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে’…..
অনেককে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়…বিচারে ৬ জনের ফাঁসি হয়…আগস্ট স্পীজ এরও ফাঁসি হয়…
তিনি তাঁর শেষ কথা বলে গেলেন ফাঁসির মঞ্চে….
‘আজ আমাদের এই নি:শব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে’…..
আমি শ্রমিক…মাহান নেতার জন্য একটিই গান গাই….
“ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান
আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?”…………
এর পর প্রায় তিন বছর কেটে গেছে……..
১৮৮৯ সালে ১লা মে, হে মার্কেট বর্বর ভাবে নিহত শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্যারিসে সমাজতন্ত্রী ও শ্রমিক পার্টি ১লা মে দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন…
এর পর থেকেই সারা পৃথিবীতে শ্রমিক স্বাধীনতার ঝড় ওঠে….ধর্মঘটের মাধ্যমে মালিকপক্ষকে নতি স্বীকার করানো হয় বহু জয়গায়..
আমরা (শ্রমিকরা)বলে উঠি.. ‘শোকতপ্ত হয়ো না, সংগঠিত হও’…..
বহু রক্তাক্ত পথ অতিক্রম করে….আজ দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের দাবি স্বীকৃত ( কতোটা বাস্তবায়িত???) ..সপ্তাহান্তে ছুটি……
‘মে দিবস’, আমি (শ্রমিক)আপনাকে ধন্যবাদ জানাই………”
পাঁচ
স্বাধীনতার পর মে দিবসকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়…
১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নামে খ্যাত কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীদের প্যারিস সম্মেলনে ১ মে তারিখটিকে দেশে দেশে শ্রমিক-শ্রেণির আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়।
রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত না হলেও ১৮৯০ সাল থেকে ইউরোপের দেশে দেশে শ্রমিক-শ্রেণি ১ মে, মে দিবস পালন করে আসছে। রুশ বিপ্লব, পশ্চিমা দেশগুলোতে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক অধিকার সম্প্রসারণের ফলে প্রথমে গুটিকয়েক দেশ ১ মে-কে শ্রমিক দিবস হিসেবে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ ১ মে-কে সর্বজনীন শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। অতঃপর অনেক দেশ এই দিনটিকে রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা করে।
কিন্তু পাকিস্তান আমলে এই দিনটিতে জাতীয় ছুটি ছিল না। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুই প্রথম মে দিবসকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি ভুলে যাননি, ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬-দফা দাবিতে আহূত প্রথম হরতালে আদমজী, টঙ্গী ও তেজগাঁওয়ের সংগঠিত শ্রমিকরাই প্রথম লাল পতাকা হাতে ১৪৪ ধারা ভেঙে ঢাকার দিকে আসতে গিয়ে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল। বাঙালির স্বাধিকার ও মুক্তির জন্য প্রথম আত্মদান করেছিল শ্রমিক মনুমিয়াসহ অন্ততপক্ষে ১০ জন শ্রমিক। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানেও ছাত্রদের পাশাপাশি শ্রমজীবী মানুষই ছিলেন চালিকাশক্তি। এ কারণেই ১৯৭১-এর ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু কেবল স্বাধীনতার ডাক দেননি, মুক্তির আহ্বানও জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েই বাংলাদেশের শ্রমিক-শ্রেণি অসহযোগ আন্দোলনে দেশের সকল কল-কারখানা বন্ধ করে দিয়েছিল। তার ডাকেই হাজার হাজার শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি মানুষ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সুতরাং এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর সরকার ১ মে সরকারি ছুটি ঘোষণা করবেন।
ছয়
মুক্তি অর্জনে আরো অনেক পথ হাঁটতে হবে…..
প্রকৃতি মুক্তি অর্জনের জন্য পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের নিম্নতম বেতনের হার বৃদ্ধি, শিশুশ্রম বন্ধ, নারী শ্রমিক ও কর্মচারীদের জন্য কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নত করা, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কৃষি শ্রমিক তথা ভূমিহীনদের বিনা জামানতে কৃষি ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা আরো জোরদার করা, শ্রমজীবী ও গরিব-দুঃখী মানুষের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করতে সোস্যাল সেফটি নেট জোরদার করা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা প্রভৃতি অব্যাহত রাখা এবং বৃদ্ধি করা, কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং সরকারি হাসপাতালগুলোয় শ্রমজীবী মানুষের বিনা খরচায় চিকিৎসা ও বিনামূল্যে ওষুধের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং শ্রমজীবী মানুষের সন্তানদের শিক্ষার যথাযথ ব্যবস্থা করার দাবী আরো জোরেশোরে তুলতে হবে।
সাত
কিছু জিজ্ঞাসা
ধন্যবাদ শ্রমিক বন্ধু…………কিন্তু আমি (মে দিবস)যদি প্রশ্ন করি
-সত্যই কি আপনি এখনো স্বাধীন….
-আপনাদের মধ্যে শিশু শ্রমের পরিমান কত…
-মহিলা শ্রমিক কি পুরুষ শ্রমিকের সমান মজুরি পায়?
-কতক্ষণ এখনো কাজ করতে হয়?
– এখনো একটা মোটামুটি জীবন যাপন করতে আট ঘন্টার সাথে কতটা ‘ওভারটাইম’ করতে হয়?
– নারীরা ঘরে প্রতিদিন গৃহে ১৬ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ করে, বছরে যার শ্রমমূল্য ১১ লাখ কোটি টাকার বেশি। এ হিসেব কি কেউ বিবেচনায় নিয়েছেন?
– কেউ কেউ একই সাথে শ্রমিক নেতা, মালিক নেতা আবার সরকারের নীতিনির্ধারণের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। মূলতঃ উনি বা উনারা কার স্বার্থ রক্ষা করেন, কেউ কি খোঁজ নিয়েছেন?
– আজও কতো শ্রমিক বাড়ি থেকে বের হয় পেটের জন্য..একটা অনিশ্চয়তার দিনকে সামনে রেখে..
ওরা কি এই ভাবেই জীবন কাটাবে….কেউ কি ওদের দেখবেনা……ওদের মুখে হাসি ফুটবে কবে?
এই, এইসব প্রশ্ন আপনাদের কাছে আমি, ‘মে দিবস’ রেখে গেলাম……………
এই ভয়ঙ্কর গ্রাস থেকে কে ওদের বাঁচাবে….সরকার না বুদ্ধিজীবি আপনারা……..?
ওরা আর কতকাল মাথা নত করে থাকবে?
আমি, মে দিবস আপনাদের কাছে জবাব চাই…………জবাব কি সত্যিই আছে?
আট
করোনা’র এই ‘অকাল’, মে দিবস এবং আমরা
প্রত্যেক মে দিবসে একটা দৃশ্য অনেক জায়গায়ই দেখা যায়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে কিছু মানুষ লাঠি হাতে রিক্সা এবং অটো চলাচলে বাধা দেয়। বলে, আজ ‘মে দিবস’। কিন্তু এবার এই দৃশ্য চোখে পড়বেনা। আজ এগুলো বন্ধ থাকবে। কিন্তু শ্রমিকদের নিয়ে ভাবনাটা কি? গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিকদের নিয়ে তো একটা খেলা চলছেই করোনা’র শুরু থেকেই। জীবনের প্রয়োজনে ‘মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান’ ভেবে নিতে বাধ্য হয়েছেন তারা৷ এছাড়াও আছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক-যারা রেস্টুরেন্টে, ছোট ছোট দোকান কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, যারা দিনমজুরি করেন, রিক্সা-ভ্যান চালান এমন সব মানুষদের জন্যে এইবারের ‘মে দিবস’এর বক্তব্য কি!!
টেলিভিশনের খবরে যানবাহন শ্রমিকদের কান্নাভেজা মুখ দেখছি। সারাবছর জুড়ে তাদের কল্যাণের নামে কতো চাঁদা সংগৃহীত হয়, কিন্তু করোনা’র এই অকালে সেই কল্যাণ তহবিলের ভুমিকা কি- এ প্রশ্নও আজ জোরেশোরে উঠছে।
“ওরা চিরকাল
টানে দাঁড় , ধরে থাকে হাল ,
ওরা মাঠে মাঠে
বীজ বোনে , পাকা ধান কাটে ।
ওরা কাজ করে
নগরে প্রান্তরে ।
…….
শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ- ‘ পরে
ওরা কাজ করে ।”
ওরা কাজ করে বলেই এই আমরা ‘ভদ্রলোকেরা’ বেঁচে বর্তে থাকি, ওদের উপর প্রভূত্ব ফলাই নানান কায়দায়।
করোনা’র এই ‘অকালে’ দাঁড়িয়ে অঙ্গীকার হোক-এই পৃথিবীটা যারা টিকিয়ে রাখে শ্রমে-ঘামে, তাদের প্রতি অবিচার অন্যায্যতা থাকবেনা- এমন একটা ব্যবস্থা বিনির্মাণে করোনা-উত্তরকালে পথ হাঁটবো আমরা।
লেখক- স্বপন পাল