–পরশ মির্জা
ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নির্মিত বিকৃত করে গাওয়া “বড় লোকের বিটি লো” শিরোনামের ভিডিও গানটি সম্প্রতি বেশ ব্যবসা করেছে। যেখানে গানটির মূল রচয়িতা রতন কাহারকে চেপে যাওয়া হয়েছিল। পরবর্তিতে চোরদের চুরামি ধরা পড়ে যাওয়ায় সমালোচনা হয়। চটে যান রতন কাহারও। এক কুমারী মাতার পিতৃ পরিচয়হীন কন্যার জন্মের কাহিনীর আলোকে তিনি গানটি রচনা করেছিলেন। কুমারী মাতা প্রেমের ফাঁদে পড়ে মিথ্যে বিয়ের প্রলোভনে প্রতারিত হয়েছিল উঁচুশ্রেণীর এক প্রতারক প্রেমিক দ্বারা। কিশোরী প্রেমিকা অন্ত:সত্ত্বা হয়ে পড়লে প্রতারক প্রেমিক পিতৃপরিচয় অস্বীকার করে। এমন করুণ পরিস্থিতে অসহায় কুমারী মাতার অাশ্রয় হয় হরিদাসী নামের এক দরদী প্রৌঢ়ার কাছে। অল্পবয়সী কিশোরী কুমারী মাতা তার শিশুকন্যার মাথার চুলের কোপা বাঁধতে বাঁধতে করুণ কাহিনী বলেছিল সে সময়ের তরুন লোকজ সংগীতশিল্পী রতন কাহারকে। যার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে (১৯৭২ সাল) তিনি রচনা করেন কালজয়ী লোকজগান “বড় লোকের বিটি লো লম্বা লম্বা চুল/অমন খোঁপায় বেঁধে দেব লাল গেন্দা ফুল!” অথচ সেই কালজয়ী লোকজগানটিকে ব্যবসায়িক ভিডিওতে রসকষিয়ে যৌন উত্তেজক সুরসুরি জাগানিয়াভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
গত ২৮ মার্চ ২০২০ তারিখে দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদের আলোকে জানা যায়, নিভৃতচারী সংগীতশিল্পী গীতিকার রতন কাহার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে বসবাস করেন। অতি দারিদ্রতার মাঝে বসবাস করে জীবনের শেষপ্রান্তে উপস্থিত হয়েছেন। বিড়ি বাঁধাই শ্রমিকের কাজ করে জীবন অতিবাহিত করেছেন। এখন বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ায় বিড়ি বাঁধাইয়ের কাজও করতে পারেন না। শীর্ণ কুটিরে বাস। সরকারী ভাতা ও টুকটাক গান করে জীবন চলছে কায়ক্লেশে। সংস্কৃতিতে অবদান রাখার জন্য জীবনে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু তাঁর অতি দারিদ্রতার মাঝে বসবাসের চিত্রটি চোখ থাকতেও কারোর চোখে পড়েনি। অর্থাভাবে চার সন্তানের কাউকেই স্কুলের গন্ডি পার করাতে পারেননি। একমাত্র মেয়েটির গানের গলা ভালো হলেও একটি হারমোনিয়াম কিনে দিতে পারেননি। মেয়েটিকে বিয়ে দেয়ার ব্যাপারে তিনি আজ চিন্তিত। এই হলো গুনী গীতিকার সংগীতশিল্পী রতন কাহারের জীবনের সংক্ষিপ্ত বাস্তব চিত্র।
বলা হয়ে থাকে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যুগযুগ ধরে বাংলা সংস্কৃতির রথীমহারথী বাঘা যতিনরা বসবাস করেন। তারা বাংলা সংস্কৃতির ঝান্ডা উড়িয়ে থাকেন। বাংলাদেশে এসেও বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে উঁচুমার্গের বয়ান দিয়ে যান। এদেশের কেউ কেউ বাংলা সংস্কৃতির বাঘা যতিনদের নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এসে তাদের বয়ান শুনে নিজেদের ধন্য মনে করেন। অথচ বাংলা সংস্কৃতির কথিত বাঘা যতিনদের দেশেই অসংখ্য জনপ্রিয় বাংলা লোকজগানের একজন গুনী গীতিকার সংগীতশিল্পী বিড়ি বাঁধাই শ্রমিকের কাজ করে খেয়ে না খেয়ে জীবনের শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছেন। অর্থাভাবে সন্তানদের স্কুলের গন্ডি পার করাতে পারেননি। মেয়েকে একটি হারমোনিয়াম কিনে দিতে পারেন নি। আর্থিক অভাব অনটনের কারণে একমাত্র মেয়ের বিয়ে নিয়েও অতশীপর বৃদ্ধ রতন কাহার আজ চিন্তিত।
রতন কাহার কোন অপরিচিত গীতিকার সংগীতশিল্পী ছিলেন না। তাঁর রচিত জনপ্রিয় লোকজগানের কারণে তিনি ছিলেন পরিচিত। তাঁর গান মঞ্চে, বেতারে, টেলিভিশনে ভেসে বেড়াচ্ছে। অথচ তিনি পড়ে রয়েছেন নিভৃত্ব পল্লীর শীর্ণ কুটিরে। অতি অভাব অনটনে দিন পার করে রতন কাহার আজ জীবন সায়ান্নে উপনীত!