পূর্বময় ডেস্কঃ
“শহরের অনেক নামী- দামি মানুষদের সাথে আমাদের পরিচয় ছিল! রেস্টুরেন্টে আসলে কতজনকে কতধরণের সেবা দিয়েছি, এখন আর কেউ খোঁজ নেয় না! সারাদিন মানুষদের কত মুখরোচক খাবার আমরা খাওয়াইছি, কিন্তু এখন আমাদের ভাতই জুটে না। ১৫দিন ধরে ৫ টাকা কামাই নাই। জমা যা ছিল তা দিয়ে কদিন হাট বাজার করে চলছি, এখন কিভাবে চলব জানিনা!”
– কথাগুলো বলছিলেন ময়মনসিংহ শহরের স্বনামধন্য একটি রেস্টুরেন্টের মেসিয়ার শফিকুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। তার মত এই শহরের প্রায় ৩ হাজার শ্রমিক আজ কর্মহীন হয়ে হতাশায় অনিশ্চিত জীবনের দিকে তাকিয়ে আছে। গত ২৬-মার্চ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের নির্দেশে শহরের সকল হোটেল রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। অথচ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ঘোষিত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী খাবারের দোকান সাধারণ ছুটির আওতামুক্ত রাখা হয়। পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই হঠাৎ করে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একদিকে যেমন শ্রমিকরা বিপাকে পড়েছে, তেমনি হোটেল প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল শহরের অনেক মানুষের প্রচণ্ড খাদ্য সমস্যাও তৈরি হয়েছে। এমনকি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৬টি ক্যান্টিন বন্ধ করে দেয়ায় চরম দূর্ভোগে পড়েছে দূর-দূরান্ত থেকে রোগী নিয়ে আসা মানুষজন।
ইউরোপের দেশগুলোতে লকডাউন চললেও ওষুধের দোকানের মত জরুরি প্রয়োজনীয় হিসেবে খাবারের দোকানগুলো খোলা রাখা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই মানুষের একান্ত জরুরী প্রয়োজনীয় আমাদের দেশের খাবারের দোকানগুলোও খোলা রাখা যেতো বলে অনেকে মনে করেন। প্রতিষ্ঠানে ভিড় না জমিয়ে ক্রেতাদের অর্ডার ও চাহিদা মত বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দেয়া বা প্রতিষ্ঠানের কোনো নির্দিষ্ট স্থান থেকে সতর্ক ও সচেতন থেকে খাবার সংগ্রহ করে নিতে পারতো বলে ভুক্তভোগীদের অনেকে মনে করেন। যেভাবে ইউরোপের লকডাউন দেশগুলিতে এই জরুরি সেবা প্রদান করা হচ্ছে। তারপরও ঐসব দেশে শ্রমিকদের বেতনের শতকরা প্রায় ৬০-৮০ ভাগ দায়িত্ব যেখানে রাষ্ট্র বহন করেছে বলে জানা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের হোটেল সেক্টরের ক্ষেত্রে মালিক ও সরকার শ্রমিকদের কোনো দায়দায়িত্ব না নিয়েই সকল হোটেল, রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। মূলত এই মহামারীর সময় বিগত সময়ের মতো ব্যবসা না হওয়ার আশংকায় মালিকরাই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার ক্ষেত্রে অধিকতর আগ্রহী ছিলেন বলে শ্রমিকরা মনে করেন। “নো ওয়ার্ক, নো পে”- এই নীতিতে চলতে গিয়ে হোটেল মালিকরা শ্রমিকদের সবেতনে ছুটি না দেয়ায় এ সেক্টরে কর্মরত দেশের প্রায় ২০ লক্ষ শ্রমিক (প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে) কিভাবে বেঁচে থাকবে সে চিন্তা কেউই করেনি।
বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট সুইটমিট শ্রমিক ফেডারেশন দুর্যোগকালীন এই সময়ে শ্রমিকদের সবেতনে ছুটি প্রদান করার জন্য কলকারখানা অধিদপ্তর এর মহাপরিদর্শকসহ বিভিন্ন জেলাতেও জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। কিন্তু কোথাও থেকে এই শ্রমিকদের দায়িত্ব গ্রহণ করার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়নি। সপ্তাহ দুয়েক আগে দেশের কোথাও কোথাও আংশিকভাবে জেলা প্রশাসন থেকে ৭কেজি, ১০ কেজি চালের অনুদান দিলেও তা দিয়ে শ্রমিকরা ২-৩ দিনও চলতে পারে নি। ফলে হোটেল শ্রমিকদের পরিবারগুলো এখন খেয়ে না খেয়ে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। কর্ম থাকাকালীন-ই শ্রমিকরা যখন পরিবার নিয়ে হিমশিম খেতো, বর্তমান পরিস্থিতিতে এখন আর কোনোভাবেই টিকে থাকতে পারছে না। ঘরে খাদ্য না থাকায় যেমন ওরা কারো কাছে হাত পাততে পারছে না, তেমনি সরকার প্রদত্ত কোন খাদ্য সহায়তাও তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। পরিবারের শিশু বাচ্চা ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা দুঃখ-কষ্টে এক মানবেতর জীবন যাপন করছে। শুধু দুই মুঠ মুড়ি ও পানি খেয়ে ঘুমাতে যেতে হচ্ছে অনেক শ্রমিক পরিবারের।
অনেক শ্রমিকদের থাকার নিজস্ব কোন ঠিকানাও নেই। আগে দিনশেষে হোটেল-রেস্টুরেন্টেই বা কেউ কেউ অস্বাস্থ্যকর ভাড়া কোন ঘরে কোনরকমে জীবন কাটাতো। এখন হোটেল প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের কোথাও থাকার জায়গাও নেই। যারা ঘর ভাড়া করে থেকেছে, তারাও মাসিক ভাড়া পরিশোধ নিয়ে পড়েছে মহাসংকটে। ফলে অসুখে চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য নিরাপত্তা শ্রমিকদের কাছে এখন দুরাশার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বরং করোনায় আক্রান্ত হওয়ার চেয়ে তাদের কাছে এখন বড় ভয় খাদ্যের। অভাবের তাড়নায় প্রচন্ড স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অভাবগ্রস্থ মানুষদের যেমন রাস্তায় বের হতে হয়েছে, হোটেল সেক্টরের এই লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদেরও সরকার ও মালিক কোন দায়িত্ব না নিয়ে জীবন ঝুঁকিতে ফেলায় তারাও খাবারের সন্ধানে বাধ্য হতে হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ খবর নেয়ার । শ্রমিকদের কেউ কেউ যোগাযোগ করেছেন জেলা প্রশাসকের সাথে। জেলা প্রশাসন থেকে পাঠানো হয় সিটি কর্পোরেশন বা পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে। সেখান থেকে কাউঞ্চিলরদের কাছে। কউঞ্চিলররা জানান, তাদের কাছে বরাদ্দ কেবল হত দরিদ্র দিনমজুরদের জন্য। কোন কোন শ্রমিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সাথেও যোগাযোগ করেছেন। সেখান থেকেও তাদের জন্য বরাদ্দ নেই বলে জানানো হয়। উপায়ন্তর না পেয়ে অনেকে হোটেল মালিকদের বাসায় বাসায় ধর্ণাও দিয়েছে। কিন্তু সেখানেও নিরাশ। ব্যবসা নাই বলে মালিক নিজেরাও নাকি আছেন বিপর্যয়কর অবস্থায়। ফলে শ্রমিকদের কোন দায়িত্ব তারাও নিতে পারছেন না। তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু- বান্ধবদের মধ্য থেকেও নেই তেমন স্বচ্ছল লোকজন, এই দুঃ সময়ে যাদের কাছ থেকে কিছু সহযোগিতা পেতে পারেন। তাই খাদ্য সংকট, অভাব ও দুঃখ- কষ্টে জর্জরিত শ্রমিক পরিবারগুলি এখনই নেতিয়ে পড়েছে। ফলে করোনার মতো প্রাণঘাতী ভাইরাস মোকাবেলা করার মত শক্তি, সাহস হারিয়ে হতাশা আর গ্লানিতে তারা নিমজ্জিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।