এমএসবি নাজনীন লাকী: বাহা’ই বিশ্বাস পৃথিবীর অন্যতম কনিষ্ঠ স্বাধীন বিশ্বাস ব্যবস্থা। সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদের পাশাপাশি যেখানে প্রাধান্য পেয়েছে মানবজাতির একত্ব ও ধর্মের সামঞ্জস্য।
বাহা’উল্লাহ বলেছেন- সকল মানুষ এবং সকল জাতি একটা মাত্র পরিবার। এক পিতার সন্তান। তাদের সেভাবেই থাকা উচিত, যেভাবে ভাইবোনেরা একে অপরের সাথে থাকে।
বাহা’ই মতবাদ সকল ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রচারকদের বৈধতা দেয়। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্মের আগমন কেবল মানুষের সাথে স্রষ্টার সম্পর্কের প্রগতিশীলতাই প্রমাণ করে।
বাহাই ধর্ম হচ্ছে পারস্যের ( বর্তমান ইরান) মির্যা হুসাইন আলী আন নূরী আল মাযিন্দারানী ওরফে বাহাউল্লাহ (নভেম্বর ১২, ১৮১৭ – মে ২৯, ১৮৯২) প্রবর্তিত একেশ্বরবাদী ধর্ম বা বিশ্বাস। তিনি নিজেকে বাবী খলিফা বলে ঘোষণা করেন। মানবজাতির আত্মিক ঐক্য হচ্ছে এই ধর্মের মূল ভিত্তি। বিশ্বের দুইশয়ের বেশি দেশে এই ধর্মের প্রায় ৭০ লাখ অনুসারী রয়েছে। পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম ধর্ম অনুসারী সম্প্রদায়।
‘বাবী’ শব্দটি আরবী ‘বাব’ থেকে এসেছে। এর অর্থ দরজা ও ফটক। মির্যা হুসাইন নিজেকে বাব তথা নিরাপদ ও আশ্রয়স্থলে প্রবেশ করার মূল ফটক হিসেবে তুলে ধরতে এ শব্দটি নিজের জন্য ব্যবহার করেন। এরপর তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করে ‘বাহাউল্লাহ’ নাম ধারণ করে। ‘বাহাউল্লাহ’ অর্থ আল্লাহর গৌরব, মহিমা বা উজ্জ্বলদীপ্ত। তার অনুসারীরা কখনো বাবী, কখনো বাহায়ী সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত।
বাহাই বিশ্বাস:
অন্যান্য ধর্মের মতো বাহাই বিশ্বাসীরা ধর্মীয় সত্যকে অপরিবর্তনীয় হিসেবে মনে করে না। বরং ধর্ম তাদের কাছে আপেক্ষিক সত্য। স্রষ্টা এক এবং অবিনশ্বর। মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞান ও চিন্তা তাকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে স্রষ্টা তার বার্তাবাহক পাঠিয়েছেন। হযরত ইবরাহীম (আ), কৃষ্ণ, জরাথুস্ত্র, হযরত মুসা (আ), বুদ্ধ, যীশুখ্রিস্ট বা হযরত ঈসা (আ) এবং হযরত মুহম্মদ (সা) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। হযরত ইবরাহীম (আ) একটি গোত্রকে একত্রিত করেছেন। হযরত মুসা (আ) করেছেন একটি সম্প্রদায়কে। নবী মুহম্মদ (সা) করেছেন একটি জাতিকে। যীশুখ্রিস্ট বা হযরত ঈসা (আ) কাজ ছিলো ব্যক্তিজীবনের পবিত্রতা। কিন্তু এটিই শেষ কথা নয়। গোটা মানবজাতির জন্য পবিত্রতা প্রয়োজন। মানবজাতির আধ্যাত্মিক, জ্ঞানতাত্ত্বিক ও নৈতিক উন্নয়নের জন্য আধুনিক যুগে প্রেরণ করা হয়েছে ‘বাব’ এবং বাহা’ইকে।
সভ্যতার ক্রম অগ্রসরতার সাথে সাথে ধর্মও প্রাগ্রসর হয়েছে। সভ্যতা তার শৈশব অবস্থা থেকে যাত্রা শুরু করে দিন দিন পরিণত হচ্ছে। নতুন যুগে তার দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই অন্যরকম হতে হবে।
আবদুল বাহা বলেছেন,
আদিম মানুষের প্রয়োজন যা দিয়ে পূরণ করা যেত, তা বর্তমান মানুষের জন্য যথেষ্ট না। এই যুগের জন্য নতুনত্ব ও পরিপূর্ণতা প্রয়োজন। এখন তাকে নতুন গুণাবলি ও সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
গোটা মানবজাতি প্রকৃতপক্ষে একটি শরীরের মতো। প্রকৃতিকে বাহাইরা স্রষ্টার গুণাবলির প্রকাশক হিসেবে দেখে। যদিও প্রকৃতির তাৎপর্য আছে. কিন্তু তা কোনোভাবেই প্রকৃতিপূজার দিকে টানে না। বলা হয়,
যতক্ষণ মানুষ পারিপার্শ্বিক প্রকৃতির খাঁচায় আবদ্ধ, ততক্ষণ সে হিংস্র পশু। কেননা অস্তিত্বের জন্য যুদ্ধ-বিগ্রহ করা বস্তুজগতের বৈশিষ্ট্য।
আত্মাকে বাহা’উল্লাহ সূর্যের সাথে তুলনা করেছেন। আত্মার কারণেই দেহ অস্তিত্বশীল হয় এবং স্থিতিশীলতা পায়। মানুষ নিজেও স্বর্গীয় গুণাবলি অর্জন করতে সক্ষম। এজন্য তাকে উপাসনা করতে হবে এবং পবিত্র গ্রন্থাবলি পাঠ করতে হবে, নানা বিপত্তি অতিক্রম করতে হবে এবং মানবতার জন্য কাজ করতে হবে। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আত্মা শরীর থেকে মুক্ত হয়ে আরো পূর্ণতার পথে অগ্রসর হয়।
বাহা’ই ধর্মীয় আদর্শ:
বাহাই শিক্ষা ও মতবাদের ভিত্তি তিনটি মূল নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত- ঈশ্বরের ঐক্য, ধর্মীয় ঐক্য, এবং মানবজাতির ঐক্য। এসকল স্বীকার্য বলে ঈশ্বর নির্দিষ্ট সময় পর পর তাঁর ইচ্ছা দূতদের মাধ্যমে ব্যক্ত করেন। আর এসকল দূতগণের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবজাতির চরিত্র পরিবর্তন ও উন্নয়ন।
বাহাউল্লাহ বলেন, ঈশ্বর ঐতিহাসিক শক্তির বলে যে গতি সৃষ্টি করেছেন তা বংশ, শ্রেণী, গোত্র, ও জাতির মধ্যে প্রচলিত বাধা ভেঙে ফেলছে এবং যথাসময়ে একটি সার্বজনীন সভ্যতার জন্ম হবে।
বাহাই বিশ্বাসের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মানবজাতির এই একতাবদ্ধ হওয়াকে সম্ভব করে তোলা। বাহাউল্লাহ শিক্ষা দেন ঈশ্বর এক, মানবজাতি এক এবং পৃথিবীর সব ধর্ম হচ্ছে এক ঈশ্বরের বিভিন্ন সময়ের প্রকাশ।
বাহাউল্লাহ বলেন, যেকথাটি পৃথিবীর সব ধর্মশাস্ত্রে বলা হয়েছে, সেই সময় এসেছে পৃথিবীর সব মানুষকে একটি শান্তিপূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধ সমাজে একতাবদ্ধ করার’। আরো বলেন, ‘এই পৃথিবী হচ্ছে একটি দেশ, ও মানবজাতি হচ্ছে তার নাগরিক।
বাহাই ধর্মের মূলনীতি:
এগুলো এসেছে বাহাই ধর্মগুরু আবদুল-বাহা’র বক্তৃতা থেকে। ১৯১২ সালে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা সফরকালে তিনি এই নীতিমালাগুলোর উল্লেখ করেছিলেন।
১। সৃষ্টিকর্তার একত্ব
২। সকল ধর্মের ভিত্তি এক
৩। মানবজাতির একত্ব
৪। স্বাধীনভাবে সত্যান্বেষণ
৫। বিজ্ঞান ও ধর্মের সমন্বয় সাধন
৬। নারী পুরুষের সমান অধিকারী
৭। সকল প্রকার কুসংস্কার অপসারণ
৮। সার্বজনীন বাধ্যতামূলক শিক্ষা
৯। সার্বজনীন শান্তি
১০। একটি সার্বজনীন ভাষা
১১।সরকারের প্রতি আনুগত্য ও গোঁড়া রাজনীতি থেকে দূরে থাকা
১২।অতিরিক্ত সম্পদ ও দারিদ্রতা বর্জন।
বাহা’ই ধর্ম গ্রন্থ:
কিতাব-ই-আক্বদাস প্রধান ধর্মগ্রন্থ। এটি বাহা’উল্লাহ ১৮৭৩ সালে রচনা করেন। এছাড়াও কিতাব-ই-আহাদ, বাহা’উল্লাহর নিয়মতন্ত্র ও তার উইল এবং টেস্টামেন্ট । এগুলো প্রকাশিত হয় ১৮৯২ সালে।
বাহা’ইদের ধর্মীয় উৎসব ও পবিত্র দিবস:
বছরে ৯টি পবিত্র দিন আছে। যে দিনগুলোতে বাহা’ইরা কোন কাজ করে না।এই দিনগুলোকে আলাদা করে নেয়া হয়েছে। কারণ এ দিনগুলোতে বাহা’ই ধর্মের কতগুলো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। সেহেতু এই দিনগুলোকে অন্যান্য সাধারণ দিনের মতো ব্যবহার করে না। ৯ দিনের ভিতরে ৭ দিন হল পবিত্র মহোৎসবের দিন এবং বাকি ২ দিন হল মহান বাব-এর শহীদ দিবস এবং বাহা’উল্লাহর স্বর্গারোহণ দিবস।
বাহা”ইদের প্রথম উৎসব নওরোজ। ২ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত উপবাস বা রোজা রাখে। এই উৎসবের দিনে উপবাস তথা রোজা সমাপ্ত হয় এবং নববর্ষের সূচনা হয়। বাহা’ইদের উৎসবের দিন সমূহ-
২১ মার্চ বাহা’ইদের নববর্ষ তথা নওরোজ দিবস।
২১ এপ্রিল রিজওয়ান দিবসের প্রথম দিবস।
২৯ এপ্রিল রিজওয়ান দিবসের নবম দিবস।
২ মে রিজওয়ান দিবসের দ্বাদশ দিবস।
২৩ মে বাবের ঘোষণা দিবস (১৮৪৪)।
২৯ মে বাহা’উল্লাহর স্বর্গারোহণ দিবস(১৮৯২)।
৯ জুলাই বাবের শহীদ দিবস(১৮৫০)।
২০ অক্টোবর বাবের জন্মদিন(১৮১৯)।
১২ নভেম্বর বাহা’উল্লাহ জন্মদিন (১৮১৭)।
বাহা’ই ক্যালেন্ডার:
বাহা’ইরা ১৯ দিনে মাস এবং ১৯ মাসে বছর গণনা করে। এদের বর্ষপঞ্জিতে ১৯ মাস, প্রতি মাসে ১৯ দিনের মধ্যে ৪/৫ দিন ইন্টার কেলারি দিবস রয়েছে যা মিলিয়ে সৌরপঞ্জি ব্যবহার করে। এটা বাব এর প্রণীত ক্যালেন্ডার। এদের বিশ্বাসে সপ্তাহে বিশেষ কোনো দিন নেই। বাহাই ক্যালেন্ডারে মাসের নাম গুলো হল- বাহা, জালাল, জামাল, আজমৎ, নূর, রহমত, কালিমাৎ, কামাল, আসমা, ইজ্জত, মশিয়ৎ, ইলম, কুদরৎ, ক্বওয়াল, মাসাইল, শরফ, সুলতান, মুলক, আ’লা।
বাহা’ইদের কিছু নিয়ম হচ্ছে:
পরনিন্দা নিষিদ্ধ।
মার্চের ২ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রাখা।
এলকোহল ও মাদক নিষিদ্ধ।
জুয়া ও উগ্রবাদিতা নিষিদ্ধ।
ভিক্ষা নিষিদ্ধ।
সমকামিতা নিষিদ্ধ।
বাহা’ই বিয়ে:
এদের খুব সাধারন এবং আনুষ্ঠানিকতা বিবর্জিত। বাবা-মা এবং বর ও কনে উভয়ের সম্মতিতে সাক্ষীর সামনে ‘অবশ্যই আমরা ঈশ্বরের ইচ্ছামত চলব’ উচ্চারণ করলেই বিবাহ হয়ে যায়।
বাহা’ই বিশ্বাসীদের একাধিক বিয়ের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে এবং তালাক বা ডিভোর্সকেও নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
বাহা’ইদের প্রার্থনা:
বাহা’ইরা ৩ ভাবে প্রার্থনা করে। ৩ টির মধ্যে যেকোনো ১টিকে ইচ্ছেমতো বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আছে। যে কোন একটি উপায় প্রার্থনার জন্য গ্রহণ করতেই হবে। তিনটির ভেতর একটি প্রার্থনা কে প্রতি ২৪ ঘন্টা অন্তর বাহা’ইদের নিশ্চিত ভাবে পাঠ করতেই হবে। এটিকে বাধ্যতামূলক দীর্ঘ প্রার্থনা বলে। এছাড়াও একটি ছোট প্রার্থনা আছে। এটিকে দিনের মধ্যে তিনবার অর্থাৎ সকাল, দুপুর এবং সন্ধ্যায় পাঠ করতে হয়। এর চেয়ে আরো ছোট প্রার্থনা আছে যেটি মাত্র একবার দুপুরবেলায় পাঠ করতে হয়।
বাহা’ইরা প্রার্থনার জন্য কিবলা হিসেবে ব্যবহার করে ইসরাইলে অবস্থিত বাহা’উল্লাহর কবরকে।
বাহা’ই উপাসনালয়:
বাহা’ই ধর্ম হল বিশ্বজনীন ধর্ম, তাই বাহা’ই উপাসনালয় হল প্রভু উপাসনার বিশ্বজনীন উপাসনালয়। যা মাশরিকুল আযকার নামে পরিচিত। বাহা’ইরা যখন উপাসনালয় নির্মাণ করে তখন তাকে তারা পৃথিবীর মানুষের উদ্দেশ্যে সমর্পন করে। জাতি,ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই উপাসনালয়ে স্বাগত। সকল ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ গুলো উপাসনালয়ে পাঠ করা হয়। বাহা’ই উপাসনালয়ে জনতা একই পরিবারভুক্ত মানুষ হিসেবে, একই ছাদের নিচে, এক পরম প্রভুর উপাসনা করার জন্য একত্রিত হয়।
বাহা’ই উপাসনালয় কাঠামোই প্রতীক। এই ঘরের নয়টি দিক থাকে এবং নয়টি দিকেই দরজা থাকে। বাহা’ই উপাসনালয়ের নয়টি দরজা এবং নয়টি গঠনরীতি দিয়ে পৃথিবীর প্রধান নয়টি ধর্মের প্রতীকরূপ বোঝানো হয়। বাহা’ই উপাসনালয়ের সামনের দরজার বা পেছনের দরজা বলে কিছু নেই। চারদিকের খোলা দরজা গুলো দিয়ে ভেতরে আলো প্রবেশ করে প্রধান বড় কক্ষটিকে আলোয় ভরিয়ে তোলে এবং সেই আলোকময় প্রার্থনা কক্ষে সকল মানুষেরা এসে স্রষ্টার উপাসনা করে। একই ঘরে সব ধর্মের ঐক্য এবং সাম্য প্রদর্শন করে। এটি এক অপূর্ব সুন্দর ভাবে মূর্ত প্রতীক।
বাহা’ই উপাসনালয় কেবলমাত্র প্রভুর উপাসনার স্থান নয় এগুলো প্রতিষ্ঠান স্বরূপ।
নয়দিক বিশিষ্ট উপাসনালয়ের নয়দিকেই মানব সেবা প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ বিদ্যালয়, অনাথাশ্রম, হাসপাতাল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নয়টি দরজা থেকে নয়মুখী মানবহিতৈষী প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যন্ত সুন্দরভাবে সাজানো। প্রতিটি পথ দিয়েই ঈশ্বরের ভবনে পৌঁছা যায়। আব্দুল বাহার তার লেখায় বাহা’ই উপাসনালয় এভাবেই পরিকল্পনা করেছেন।
৯ বাহাই দের কাছে খুবই পবিত্র সংখ্যা। ৯ কোনা বিশিষ্ট তারা তাদের প্রতীক। বাহা বা সমুজ্বল এর সংখ্যা মুল্য ৯ ধরা হয়। বাব এটিকে প্রচলিত করেন।
বর্তমানে পৃথিবীর সাতটি মহাদেশের মধ্যে অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া প্রতিটি মহাদেশেই মহাদেশীয় উপসনালয় রয়েছে। এশিয়ার ভারতে একটি, উত্তর আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইলমেটে একটি, উত্তর আমেরিকার পানামায় একটি, দক্ষিণ আমেরিকার চিলির সান্তিয়াগোতে একটি, আফ্রিকার উগান্ডার কাম্পালায় একটি, অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে একটি, অস্ট্রেলিয়ার সামোয়ার এপিয়ায় একটি এবং জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে একটি। ছয়টি মহাদেশের আটটি উপাসনালয়কে মাতৃমন্দির বলা হয়।
।বাংলাদেশে বাহা’ই সম্প্রদায়:
১৮৭৬ সালে সোলেমান খান যিনি জামাল এফেন্দী নামে অধিক পরিচিত স্বয়ং বাহা’উল্লাহর আদেশে বাহা’ই ধর্মের বার্তা নিয়ে ভারত উপমহাদেশে আসেন। জামাল এফেন্দী মোস্তফারুমীসহ ১৮৮০-র দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশে আসেন এবং ঢাকায় এসে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেসময় বাংলাদেশ ছিলো ব্রিটিশ ভারতের একটি অংশ।
১৯২১ সালে নারায়ণ রাও উকিল বাংলাদেশে আসেন এবং তিনি ঢাকা ও ময়মনসিংহে বাহা’ই ধর্মের বাণী প্রচার করেন।
ধারণা করা হয়, জামাল এফেন্দি-ই হচ্ছেন প্রথম একাধিকবার ঢাকায় এসেছিলেন।বার্মায় থাকাকালীন সময়ে বর্তমান বাংলাদেশে অবস্থিত চট্টগ্রামের একটি গোষ্ঠী বাহাই ধর্মকে গ্রহণ করে। ১৯৫০-এর দিকে এই ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ক্রমশঃ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাহা’ই সমাজ গড়ে ওঠে এবং ১৯৫২ সালে ঢাকায় বাংলাদেশের প্রথম স্থানীয় আধ্যাত্মিক পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে বাহা’ইদের জাতীয় আধ্যাত্মিক পরিষদ গঠিত হয়।
২০০৫ সালে ওয়ার্ল্ড ক্রিশ্চিয়ান এনসাইক্লোপিডিয়ার এক জরিপ অনুসারে বাংলাদেশে বাহাই ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ১০,০০০। বাংলাদেশ জাতীয় বাহা’ই কেন্দ্র, ঢাকা-এর তথ্যমতে বর্তমানে (জানুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত) বাংলাদেশে বাহাই বিশ্বাস এর জনসংখ্যা প্রায় ২০০০০। আর ময়মনসিংহ বাহা’ই কেন্দ্র -এর তথ্য মতে ময়মনসিংহ বিভাগে লোকসংখ্যা প্রায় ৭৫০০। বাংলাদেশে সাতটি বাহা’ই কেন্দ্র রয়েছে। এগুলো হলো- ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, যশোর এবং রংপুর। ময়মনসিংহ বাহা’ই কেন্দ্র টি ২২ কালীবাড়ী রোড এ অবস্থিত।
সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও মানবিকতায় বাহা’ইদের বাংলাদেশে বসবাস:
বাহা’ই বিশ্বাসী লোকেরা বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো সহিংসতার শিকার হয়নি। তবে সামাজিকভাবে স্থানীয় অন্য ধর্মাবলম্বী লোকজন বাহা’ই বিশ্বাসীদের কিছুটা এড়িয়ে চলে। বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। সরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রে এরা কোনপ্রকার বৈষম্যের শিকার হয় না। এরা যোগ্যতা অনুসারে স্বাধীনভাবে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে। পাঠচক্রের আয়োজনের মাধ্যমে এরা নতুন বাহা’ই সদস্যদের জ্ঞান অর্জনে উৎসাহিত করে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বাহাই ধর্ম বিষয়ক সেমিনার করে থাকে। সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে মানবজাতির সুখ ও অগ্রগতির বিভিন্ন দিকের সাথে সম্পর্কিত প্রয়াস গুলিতে নারী ও পুরুষ, শান্তি, শাসন, জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের মতো বিষয়গুলির উপর সেমিনার করে থাকে। সমাজের উন্নতির জন্য অবদান রাখতে বাহা’ইরা বাহা’উল্লাহ কথা স্মরণ রাখে।
বাহা’উল্লাহ বলেছেন, সৃষ্টিকর্তার ধর্ম প্রেম এবং ঐক্যের জন্য। একে শত্রুতা ও বিচ্যুতিতে পর্যবসিত করো না।
অনেকে বাহা’ই সম্প্রদায়কে ইসলাম ধর্মের ই আরেকটি শাখা মনে করে। এটা ঠিক নয়।বাহা’ইরা তাদের ধর্মকে একটি স্বতন্ত্র ধর্ম হিসেবেই দাবি করে এবং তারা মনে করে তাদের ধর্ম সকল ধর্মেরই একটি সম্মিলিত রুপ।