বাবলী আকন্দ ঃ সোমবার সকাল! ঘুম থেকে উঠেই বরাবরের অভ্যাসের মতো আধো চোখবোজা অবস্থায় মোবাইল দেখা। কোন গুরুত্বপূর্ণ কল আছে কি না সেটা দেখে নেয়া। প্রতিদিনকার ঠিক অভ্যাসের মতো গতকাল ভোরে মোবাইল দেখে চমকে উঠার মতো। আমাদের অফিসের আপার কল। এতো সকালে তো উনার কল দেয়ার কথা না। সাথে সাথেই কল ব্যাক করলাম।
ওপাশ থেকে আপা কান্নাজড়িত করুণকন্ঠে বলে উঠলেন, আপা,আইজকা অফিসে আইতে পারতাম না। আজকে বুল্ডুজার দিতাসে। বাড়ি ভাংতাসে। সাথে সাথেই আমার প্রশ্ন, এখন আপনারা কিভাবে থাকবেন! আপা বললেন, পর্দা টানাইয়া থাকতে হইবো। আমি বললাম, ঠিক আছে আজ আসতে হবে না অফিসে। বলে মোবাইলটা রেখে থুম (গম্ভীর) ধরে বসে রইলাম। ভাবনা চিন্তার কুল কিনারা পেলাম না।
যাই হোক, আপা থাকেন ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্রের বাঁধ ঘেঁষে গড়ে উঠা বস্তির নিচের দিকে মানে বেড়িবাঁধের নিচে। যেখানে প্রায় ৫০০ পরিবারের বাস। উপরে নিচে মিলিয়ে প্রায় সহস্রাধিক পরিবার এই বস্তিতে বাস করে। আপার কথা ভাবতে ভাবতে ফ্রেস হয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি হয়ে রওয়ানা দিলাম। আজ নেহাতয়ই আমার ভাগ্য ভালো যে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের দেখা পেলাম। উনি মিষ্টি হেসেই আমাকে স্বাগত জানালেন। কথা বলে বের হয়ে আসলাম। অন্যান্য কাজ সেরে অফিসে এসেই ক্ষুধা লাগলো। কিন্তু আপা আসেনি বলে খাওয়াটাও হলো না। হঠাৎ পর পর দুবার মিসকল। কল ব্যাক করতে যাবো এমনি আবারো কল।
অপরিচিত নাম্বার। রিসিভ করে সালাম দিতেই এক বৃদ্ধার কান্নার আওয়াজ। কয়েক সেকেন্ড যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম আমাদের অফিসে আপার শ্বাশুড়ী। কান্না করছেন আর বলছেন, মায়াগো, আমরা এহন কই যায়াম!আমগোর সব শেষ। কি করবাম আমরা! আমি খালাম্মা কে স্বান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার নিজেরই গলার স্বর পাচ্ছিলাম না। ভারী হয়ে যাচ্ছিল কন্ঠ। খালাম্মা বললেন, মাগো, একবার আইয়ো,দেইখা যাও আমগরে। তোমারে দেহি মা। আমি বললাম,ঠিক আছে খালাম্মা। আমি আসছি। কলটা কেটেই কোনমতে নিজের মনকে নিজেই স্বান্তনা দিতে লাগলাম।
দীর্ঘ বছর থেকে বসবাস করে আসা এসব মানুষ এখন শংকায় দিন কাটাচ্ছেন। সাথে সাথেই বের হয়ে চলে গেলাম থানাঘাটে। গিয়ে দেখলাম নিচের অংশের সব ধ্বংসস্তুপ। কেউ কেউ নিজের জিনিসপত্র গুছাচ্ছেন। কেউ গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। বেশিরভাগ পরিবারে রান্না হয়নি। অনেকেই আবার গোল হয়ে আলোচনা করছেন। আলোচনার বিষয় একটাই উচ্ছেদ। খালাম্মা আমাকে দেখে কান্না শুরু করে দিলেন। কিভাবে স্বান্তনা দিবো বুঝতে পারছিলাম না। আপা এসে জানালেন, সকালে আলুভর্তা আর ডাল রান্না করে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হবেন এমন সময় বুল্ডুজার গিয়ে হাজির। দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যায় সবার মাঝে। তাঁর ছোট ছোট দুটি সন্তানও খেতে পায়নি। তারা সবাই না খেয়ে আছেন। আশেপাশে দোকান তখনো বন্ধ ছিল। কিছু কিনে এনে খাবে নাকি জিনিসপত্র গোছাবে,সে সময় কই!
উপরের বস্তিটিও নাকি ভাঙ্গার নির্দেশ দিয়েছেন ইউএনও। প্রায় ১০,০০০ মানুষের এখন আশংকায় দিন কাটছে। সেই সাথে প্রকৃতিও নিষ্ঠুর হয়েছে তাদের প্রতি। জেঁকে বসেছে শীত। সহায় সম্বলহীন, আশ্রয়হীন মানুষগুলো শীতে কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিবে, এটা ভেবেই অস্থির মন ভাবনাগুলো মেলতে পারছে না।
তাঁদের অনেকেই বলছেন, অন্য দেশ থেকে এসে রোহিঙ্গাদের ঠাই বাংলাদেশ ঠিকই দিয়েছে, কিন্তু নিজ দেশে আমাদেরই ঠাই নাই।
ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহর ঘেষা ব্রহ্মপুত্র নদ ভরাট করে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের সোমবার থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট ও সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) এম সাজ্জাদুল হাসান ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট এস এম আবুল হাশেমের নেতৃত্বে এ অভিযান শুরু করা হয়।
অভিযানে পানি উন্নয়ন বোর্ড, কোতোয়ালী পুলিশ, এপিবিএন, ব্যাটালিয়ন জেলা প্রশাসনকে সহায়তা করেন। ব্রহ্মপুত্রের বাঁধের নিচের অংশটুকুতে ঘর ভাঙ্গা মানুষগুলো নদী তীরবর্তী এলাকায় কাপড়, ত্রিপাল ব্যবহার করে অস্থায়ী ঘর তুলেছেন। প্রচন্ড শীত আর নদীর পাড়ে বাতাস বয়ে যাওয়ার কারণে তীব্র শীতে এ মানুষগুলো অসহায় আর নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছেন প্রশাসনের দিকে। খোলা আকাশের নিচে অনেককে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করতে দেখা গেছে। সবচেয়ে অসুবিধায় পড়েছেন বৃদ্ধ আর শিশুরা।
বেড়িবাঁধের উপরিঅংশ উচ্ছেদ ও এদের পূনবার্সনের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে জেলা প্রশাসক মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, শীতের কথা ভেবে আমরা ভেতরের দিকে উচ্ছেদের কথা এক্ষুনি ভাবছি না। আর মন্ত্রণালয় থেকে যদি পূনর্বাসনের কথা বলা হয় তবে অবশ্যই পূনর্বাসিত হবে তবে এখন পর্যন্ত পূনবার্সনের কোন নির্দেশনা নাই।
এ ব্যাপারে ৮ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফারুক হাসানের সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমরা উচ্ছেদের পক্ষে আছি। সরকার আমাদের জন্যই বড় পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন এ কে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু দীর্ঘ ৩৫ বছর থেকে বসবাস করে আসা এ মানুষগুলো কে পূনর্বাসনের প্রয়োজন।
এ নিয়ে তারা গত ১৯ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসক বরাবর একটি আবেদন জমা দিয়েছিলেন। যেখানে উল্লেখ ছিল, ময়মনসিংহের সদর উপজেলাধীন ময়মনসিংহ টাউন মৌজার লাগস্থ ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন এর অধীন ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত চর ঈশ্বরদিয়া মৌজার ১ নং খাস খতিয়ানভুক্ত সাবেক ১৩৮১ দাগের ভূমি বন্দোবস্ত পাওয়ার জন্য সরকারী বিভিন্ন দপ্তরে আবেদনের পরও স্থায়ী পূনর্বাসন বা আবাসনের কোন ব্যবস্থা না হওয়ায় পরবর্তীতে ব্রহ্মপুত্র বাস্তুহারা কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমতি লিঃ মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট ডিভিশনে উল্লেখিত দাগের ১২.২০ একর ভূমি দীর্ঘ মেয়াদী বন্দোবস্ত প্রাপ্তির জন্য রিট পিটিশন নং ৫৯৯৩/২০১০ দায়ের করলে রিট পিটিশন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থিতিবস্থানের আদেশ দিয়েছেন মহামান্য আদালত।
অন্যদিকে ময়মনসিংহের সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর এমসিসি/ প্রশা/সাধা/২০১৯/ ২৭৬৪ তাং ১৭/১২/২০১৯ স্বারকে চিঠি পাঠিয়েছেন। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র বাস্তুহারা কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতিসহ নদের তীরবর্তী এলাকায় প্রায় চল্লিশ হাজার ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীসহ বেশ কয়েকটি মসজিদ,মাদ্রাসা,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার সুস্পষ্ট ঘোষণা যতক্ষণ পর্যন্ত না বস্তির মানুষদের পুনর্বাসনের বা আবাসনের ব্যবস্থা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন বস্তি উচ্ছেদ করা যাবে না। ছিন্নমূল বস্তিবাসীদের মানবিক দিক বিবেচনা করে উচ্ছেদ নাকরণের জন্য দাখিলকৃত আবেদন বিবেচনার কথা বলা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের লক্ষে পালিত হবে মুজিব বর্ষ। আগামী ১০ জানুয়ারি, ২০২০ থেকে মুজিব বর্ষ গণনা শুরু হবে। বঙ্গবন্ধুর গড়া সাধারণ মানুষের জন্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা,এদেরকে বাদ দিয়েই কি করা সম্ভব! মুজিব বর্ষে জাতির পিতাকে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে স্মরণ করা হবে। ভূমিহীন, বাস্তুহারা মানুষদের আশ্রয় দিয়ে লাখো শহীদের রক্তে গড়া বাংলায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার অংশীদার হিসেবে মুজিববর্ষে আশ্রয়ন উপহার দেয়া কি যায় না! মুজিব বর্ষে বস্তিবাসীদের এমনটাই প্রত্যাশা।