সুদীপ্ত শাহিন ( সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, ময়মনসিংহ জেলা ):
বাংলাদেশ একটি নয়া-ঔপনিবেশিক আধা-সামন্তবাদী দেশ। এদেশের শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেলেও এখনো পর্যন্ত মোট জনসংখ্যার মধ্যে কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু কৃষি উৎপাদন যেহেতু অবৈজ্ঞানিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক সেকারণে এই শ্রমশক্তির মধ্যে নিজেদের অধিকার ও গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার সুরক্ষার প্রেক্ষিতে সচেতনতাবোধ কম। অন্যদিকে জনগণের নেতৃত্বকারী অংশ হিসেবে দেশের গোটা শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে শিল্প শ্রমিকদের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম থাকায় প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও অধিকার আদায়ের প্রেক্ষিতে সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে অনগ্রসরতা রয়েছে। উপরন্তু শাসক- শোষক গোষ্ঠীর দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ট্রেড ইউনিয়ন তৎপরতাকে আরো জটিল করে তুলছে।
এমন অবস্থায় গোটা জনসমষ্টির মধ্যে ছাত্ররাই সচেতন অংশ হিসেবে এদেশের সমাজে প্রতীয়মান হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান, কলা-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য -এসব পড়াশোনার মধ্য দিয়ে ছাত্রছাত্রীরা দেশপ্রেম মানবিকতাবোধ, জাতীয়তাবোধ, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি সচেতন হয়ে উঠে । ফলে তারা ন্যায়-অন্যায় ও প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল বিষয়বস্তুর মধ্যকার পার্থক্য নির্ধারণ করতে জানে । এ সমস্ত কারণে ল্যাটিন আমেরিকার নয়া-ঔপনিবেশিক দেশের মত আমাদের দেশের ছাত্র সমাজও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখে। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলনসহ সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরাচারবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে এদেশের ছাত্র সমাজ গৌরবোজ্জ্বল সাহসী ভূমিকা রেখেছে। তাই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তার এদেশীয় দালাল স্বৈরাচারী সরকারগুলো যখনই জনস্বার্থবিরোধী তৎপরতা গ্রহণ করতে চলেছে, তখনই এদেশের ছাত্র সমাজের প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ এ দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা নীতি, শিল্পনীতি, কৃষিনীতি -এ সবকিছুর উপরে উলংগ আগ্রাসন চালানোর জন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার এজেন্ডা দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে আসছে। তবে সচেতন ছাত্র সমাজ বরাবরই এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছে।
২য় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রাজ্যবাদের নয়া-ঔপনিবেশিক কৌশল বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে এবং ভারতীয় মুৎসুদ্দি পুঁজির সাথে দ্বন্দ্বের ফলে ১৯৪৭ সালে ভারত, পাকিস্তান বিভক্ত হয়। পূর্ব ও পশ্চিম -এই দুই অংশ নিয়ে গঠিত পাকিস্তানের মুৎসুদ্দি পুঁজির নেতৃত্ব প্রদান করে মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্যকারি জাতিসত্তা সমূহের দালাল পুঁজি। এই পুঁজির রাজনৈতিক দল ছিল মুসলিম লীগ এবং এর ছাত্র সংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন- এনএসএফ। তৎকালীন সময়ে গোটা পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসগুলিতে গুন্ডামি, মস্তানি, সন্ত্রাসী কার্যক্রম এই এনএসএফ- নেতা কর্মিরাই করতো। আর এদের পৃষ্ঠপোষকতা করতো স্বৈরাচারী মুসলিম লীগ সরকার। তখন মার্কিন মদদেই সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদের শ্লোগান নিয়ে বাঙালি মুতসুদ্ধি পুঁজির ক্ষমতায়নের জন্য অবাঙালীদের সাথে দ্বন্দ্ব তৈরি করে। তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগও এই উগ্র-বাঙালি জাতীয়তাবাদের শ্লোগান নিয়ে সক্রিয় থাকে শিক্ষাংগণে। কিন্তু সাংগঠনিক দুর্বলতা ও রাষ্ট্রের বৈরি মনোভাবের কারণে এই সংগঠন তৎকালীন সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। প্রগতিশীল সংগঠন হিসেবে এনএসএফের মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে তখন গোটা শিক্ষাঙ্গনে সাংগঠনিক প্রভাব বিস্তার করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। ছাত্রলীগ তখন নিজেদের রক্ষা ও অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য ক্যাম্পাসে ছাত্র ইউনিয়নের সাথে লিঁয়াজো করে চলত।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ বাঙালি মুতসুদ্ধিদের প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয় এবং আওয়ামীলীগের সাথে সাথে তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের উগ্র জাতীয়তাবাদের স্বরূপ ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে সেভেন মার্ডারের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ক্যাম্পাসকে রক্তাক্ত করতে থাকে। পরবর্তীতে সাম্রাজ্যবাদের দালাল হিসেবে বিএনপি, জাতীয়পার্টি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয় এবং যথাক্রমে তাদের ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও জাতীয় ছাত্র সমাজ ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও ক্যাম্পাস হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। সর্বশেষ বিগত ৩টার্ম আওয়ামী লীগ তথাকথিত গণতন্ত্রেরও সবকিছু বলী দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকলে এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনগুলি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, লুটপাট, সন্ত্রাসী – এমন হেন কোন অপকর্ম নেই যা এসব সংগঠনগুলোর নেতা- কর্মিরা করছেনা। আর এসবের প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে খোদ সরকার ও প্রশাসন। ফলে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বা পাড়া-মহল্লায় উঠতি বয়সের তরুণরা কোনরকম ভাবে ছাত্রলীগের সিল লাগাতে পারলে সমস্ত অপকর্মের বৈধতা তারা নিয়ে নেয়। প্রশাসনের সাথে সাথে এদের আবার মদদ দিয়ে যায় নির্লজ্জভাবে দলীয়করণ হওয়া কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মানহীন, ব্যক্তিত্বহীন, পতিত শিক্ষকেরাও। ফলে এই দুর্বৃত্তরা জিম্মি করে ফেলে দেশের গোটা শিক্ষাঙ্গনকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডারবাজি, ভর্তি বাণিজ্য -এসমস্ত অপকর্ম এসব পতিত ছাত্র-শিক্ষকদের সমন্বয় ঘটতে থাকে। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্বলতা ও সীমিত আকারে হলেও সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষে অবস্থান নেয় ও বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায় বাম প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন সমূহ।
সম্প্রতি বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার-কে ছাত্রলীগ নৃশংসভাবে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সারাদেশ স্তম্ভিত। উত্তাল হয়ে উঠছে সারাদেশের শিক্ষাঙ্গণ। ছাত্রলীগের প্রতি দেশব্যাপী সর্বস্তরের মানুষের তৈরি হচ্ছে ঘৃণার উদ্রেক। আবরার- কে যে কারণে হত্যা করা হলো, ভারতের সাথে দেশবিরোধী ও জনস্বার্থবিরোধী চুক্তির বিরুদ্ধে দেশের আপামর জনগণও সোচ্চার হয়ে উঠছে। ফলে দেশের জনগণ ও ছাত্রসমাজ তাদের প্রাপ্য হিসাব বুঝে নেয়ার যখন সময়ক্ষণ তৈরি করছে, সেই সময়ে একদল লোক চেঁচামেচি করছে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের। এসব ধাপ্পাবাজ লোকদের প্রোফাইল ঘাঁটলে দেখা যায়, এরা চিন্তায়, মগজে বা কাজে উগ্র চিন্তার দাসত্বে বন্দি। যখন সোচ্চার ইতিবাচক রাজনীতি দিয়ে ছাত্রলীগের মতো নেতিবাচক, প্রতিক্রিয়াশীল সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠনকে অবাঞ্চিত করার উপক্রম, তখন এসব ধাপ্পাবাজদের জনপ্রিয়(!) স্লোগান হচ্ছে – “ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করো “। যা আসল কুকর্ম ঢাকতে এবং ভারতের সাথে দেশ ও জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি ঢাকতে ছাত্র সমাজের কথা বলার, প্রতিবাদ করার শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার অপকৌশল। বুয়েটের রাজনীতি অসচেতন ছাত্রদের দিয়ে এই অপকৌশল বাস্তবায়নের চেষ্টাও প্রতীয়মান হচ্ছে। তাই আবরার হত্যার বিচার দাবির ব্যানার বুয়েটের অসচেতন ছাত্রদের হাতে না দিয়ে, নিতে হবে দেশের সচেতন ছাত্র সমাজের হাতে। দেশ, জনগণের পক্ষে অবস্থান নিতে জাতীয় ও জন্স্বার্থবিরোধী যে চুক্তির বিরোধীতা করে শহীদ হলেন আবরার, সেইসব চুক্তি বাতিল সহ সাম্রাজ্যবাদের দালাল স্বৈরাচারী সরকারের জনস্বার্থবিরোধী সকল অপতৎপরতা প্রতিহত করে আবরার হত্যার বিচার সুনিশ্চিত করতে হবে।