পরশ মির্জাঃ হবিগঞ্জের সুতাং বাজার। শায়েস্তাগঞ্জ ও শাহজিবাজারের মাঝামাঝি এর অবস্থান। গ্রামবাংলার অার দশটি গ্রামীণ বাজারের মতই এর পরিবেশ প্রতিবেশ। চারপাশ সবুজে ঘেরা। পাখিদের কলকাকলি, শিশুদের হইহুল্লুড় অার বাজারে অাগতদের কোলাহল দিনমান। খরস্রোতা খোয়াই নদী থেকে অাসা সুতাং নদী বয়ে গিয়েছে সুতাং বাজারের পাশ ঘেঁষে। ঢাকা-সিলেট রেললাইন অতিক্রম করে চলে গিয়েছে দূর প্রান্তে। এই সুতাং বাজারেই বাস ছিল সুখিয়া রবিদাসদের। যুগযুগ ধরে বংশপরম্পরায়। সুখিয়া বড় হয়েছে সুতাং বাজারের মাটিতেই। ছোটবেলায় ঘুরে বেড়াত বাজারের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। বাজারের পশ্চিম প্রান্তে সৈয়দবাড়ী। প্রতিবছর সৈয়দবাড়ীর সম্মুখে বিস্তর জায়গায় শীতকালে বসে মেলা অার মহররম মাসে হয় জিকির অাসগার। বের হয় তাজিয়া মিছিল।
সুখিয়া ছোটবেলায় ছুটে অাসত সৈয়দবাড়ীর অাঙ্গিনার শীতের মেলায়। শিশুমন ঘুরে বেড়াত মেলার এক প্রান্ত থেকে অারেক প্রান্তে। মায়ের কাছ থেকে অানা পয়সায় কিনতো বিনিসুতোর মালা, চুলের ফিতা। কিনে খেতো নাড়ু, লজেন্স। অারও কত কি! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতো নাগরদোলার ঘুর্নন। নাগরদোলা তাকে যেমন অাকর্ষণ করতো তেমনি দেখে ভয়ও হতো। কিন্তুু শিশুমন কি মানে! ভয় পরাস্ত হয় অাকর্ষণের কাছে। সুখিয়াও নাগরদোলায় ছড়ে বসত। সে কি অনুভূতি!
প্রতিবছর মহররম মাসে সৈয়দবাড়ীর সম্মুখে জিকির অাসকার হয়। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে জড়ো হয়। শিরনি রান্না হয়। অাগত মানুষজনের মাঝে তা বিতরন হয়। হাসান হোসেনের শাহাদতের দিন বের হয় তাজিয়া মিছিল। মিছিল প্রদক্ষিণ করে পুরো সুতাং বাজার এলাকা। রব উঠে, হায় হাছান হায় হোসেন! সুখিয়া ভিন্ন ধর্মের হলেও সেও ছুটে অাসত তাজিয়া মিছিল দেখতে। অবাক বিশ্ময়ে দেখতো তাজিয়া মিছিল। শুনতো হায় হাসান হায় হোসেন ধ্বনি। শিশুমন কি অার ধর্ম বুঝে। মানুষই যে তার কাছে পরম ধর্ম। অসাম্প্রদায়িক পরিবেশের মাঝেই বড় হয় সুখিয়া।
সুখিয়ার বিয়ে হয় তাদেরই সম্প্রদায়ের যুবক মতিলাল রবিদাসের সাথে। রবিদাস শব্দটির মাঝেই সুখিয়াদের বংশপরিচয় প্রকাশ পায়। পাশাপাশি কর্ম পরিচয়ও। বংশপরম্পরায় সুখিয়ারা সুতাং বাজারে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করে জীবন নির্বাহ করতো। কেটে যাচ্ছিল সুখিয়ার সংসার জীবন। একদিন হঠাৎ খুন হয় সুখিয়ার স্বামী মতিলাল। ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় সুখিয়ার সংসার স্বপ্ন। সেই থেকে সুখিয়ার বিধবা জীবন। চাচার অাশ্রয়ে ঠাঁই হয়। অসহায়ত্বের জীবনে সহায় কি স্থায়ী হয়? হয় না। সুখিয়ারও হয়নি। অাবারও খুন। খুন হয় সুখিয়ার চাচা একই চক্রের হাতে। প্রকাশ হয়ে পড়ে হত্যাকারীদের মতলব। হত্যাকারীদের লোলুপদৃষ্টি সুখিয়াদের বসতভিটার প্রতি। বাজার এলাকার মাটির দাম অনেক। তাই দখল করতে মরিয়া হত্যাকারী প্রভাবশালী চক্রটি। তাই তো পর্যায়ক্রমে নিহত হয় সুখিয়ার স্বামী মতিলাল ও তার চাচা। সুখিয়া স্বামী হত্যার বিচার পায়নি। টাকার অভাবে মামলা চালাতে পারেনি। মামলাটি এমনিতেই তামাদি হয়ে যায়। সুখিয়া বুঝে নেয় এ সমাজ রাষ্ট্রে বিচার পাওয়ার অাশা যেন দূরাশা। বিচারের বাণী যে নিরবে নিভৃতে নয় অাজ প্রকাশ্যে কাঁদে। সুখিয়া তার চাচার হত্যা মামলা হয় প্রধান সাক্ষী। সুখিয়া তার স্বামী হত্যার বিচার পায়নি। চাচা হত্যার বিচারও কি সে পাবেনা! মনে মনে ভাবে সুখিয়া। সে যে হত্যার বিচার চায়।
সুখিয়ার স্বামী ও চাচা একই চক্রের হাতে খুন হয়। এই চক্রেরই একজন শাইলু মিয়া। ১৮ মামলার অাসামি। এতগুলো মামলার অাসামী হলেও শাইলু মিয়া ঘুরে বেড়ায় সমাজে বুক চিতিয়ে। এ সমাজ যেন শাইলু মিয়াদের অভয়ারণ্য। বিচরন করে অবাধে।
প্রতিদিনের মত স্বামী হারানো, চাচা হারানো ৩০ উত্তীর্ণ বিধবা রমনী সুখিয়া রবিদাস একদিন সকালে ঘরের কাজে ব্যস্ত। তার স্বামী ও চাচার হত্যাকারী শাইলু মিয়া হঠাৎ ঘরে প্রবেশ করে। দুর্বল ঘর, দুর্বল ঘরের দরজা। কিছু বুঝে উঠার অাগেই জাপটে ধরে সুখিয়াকে। করে ধর্ষণ। একপর্যায়ে সুখিয়া ঘর হতে বের হয়ে দৌড় দেয়ার চেষ্টা করে। শাইলুও ঘর থেকে বের হয়। লাঠি দিয়ে অাঘাত করে সুখিয়াকে। মাথায় অাঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে সুখিয়া। অাস্তে অাস্তে দেহখানি নিস্তেজ হয়ে যায়। ঢলে পড়ে মৃত্যুরকুলে!