স্বপন পাল ঃ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও সাম্যবাদী দার্শনিক যতীন সরকারের ৮৪ তম জন্মদিন আজ। ১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট কেন্দুয়া উপজেলার রামপুর বাজার সংলগ্ন চন্দপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র সরকার। মা বিমলা বালা সরকার। ১৯৪৩ সালে রামপুর ফ্রি বোর্ড প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন। এ স্কুলে তিন বছর পড়ালেখা করেন। তার পর চলে যান মুক্তাগাছায় মামার বাড়িতে।
সেখান থেকে ফিরে ১৯৪৮ সালে বাবার জ্যাঠাতুতো বোনের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে ভর্তি হন নেত্রকোণার চন্দ্রনাথ স্কুলে। এই স্কুলেও বেশিদিন পড়তে পারেননি। দেশ ভাগের কারণে তার পিসিমার ছেলেরা কুচবিহার চলে গেলে তিনি চলে যান পাশের গ্রামের বেখৈরহাটি স্কুলে। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত তিনি এ স্কুলে পড়াশোনা করেন।
১৯৫০ সালে দাঙ্গার কারণে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৯৫১ সালে ভর্তি হন আশুজিয়া স্কুলে। ১৯৫৪ সালে মেট্রিক পাশ করেন যতীন সরকার। ১৯৫৫ সালে আইএ ভর্তি হন নেত্রকোনা কলেজে। কলেজের ছাত্র সংসদে সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি । আইএ পাশ করার পর ১৯৫৭ সালে আনন্দমোহন কলেজে বিএতে ভর্তি হন। ১৯৫৯ সালে বিএ পরীক্ষা দিয়ে আশুজিয়া হাই স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন।
বিএ’র রেজাল্ট হবার পর বারহাট্টা সিকেপি হাই স্কুলে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত চাকরি করেন। দুই বছর শিক্ষকতার টাকা জমিয়ে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৩ সালে এমএ পাশ করেন। ১৯৬৩ সালে বাংলার শিক্ষক হিসেবে গৌরীপুর হাই স্কুলে যোগদান করেন। এর এক বছর পর ১৯৬৪ সালে যোগ দেন ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে এবং এখান থকেইে অবসান ঘটে তাঁর চাকুরী জীবনরে।
ছেলে সুমন সরকার চেকোশ্লাভাকিয়া প্রবাসী, কন্যা সুদীপ্তা সরকার বচিারক হিসেবে কর্মরত। একমাত্র ভাই অধ্যাপক মতীন্দ্র সরকার নেত্রকোনা সরকারী কলেজের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক।
১৯৬৭ সালে তিনি কানন আইচ এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। গদ্য চর্চায় রত এই লেখকের প্রথম পুস্তক প্রকাশতি হয় ৫০ বছর বয়সে। ১৯৮৫ সালে মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত হয় ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’। এরপর আর থামেননি। বিরামহীন লিখে চলেছেন তিনি।
তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলঃ প্রবন্ধ গ্রন্থ: ১। সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা, ২। বাঙ্গালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য ৩। সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবি সমাচার ৪। সংস্কৃতির সংগ্রাম ৫। ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভূত ভবিষ্যৎ ৬। আমাদের চিন্তা চর্চার দিকদিগন্ত ৭। ভাষা সংস্কৃতি উৎসব নিয়ে ভাবনা চিন্তা ৮। প্রাকৃত জনের জীবনদর্শন ৯। দ্বি-জাতিতত্ত্ব, নিয়তিবাদ ও বিজ্ঞান চেতনা ১০। বাংলাদেশের কবিগান ১১। ভাবনার মুক্ত বাতায়ন ১২। বাংলা কবিতার মূলধারা ও নজরুল ১৩। বরণীয় জনের স্মৃতি, কৃতি, নীতি ১৪। বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি ১৫। গল্পে গল্পে ব্যাকরণ ১৬। রাজনীতি ও দুর্নীতি বিষয়ক কথাবার্তা ১৭। আমার যেটুকু সাধ্য ১৮। আমার রবীন্দ্র অবলোকন ১৯। মানব মন, সমাজ ধর্ম ও মানব বিপ্লব ২০। মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা ও আন্তর্জাতিক ভাষা ২১। বিচিত্রবিধ বিচার বিবেচনা। ২২। সমকালের দর্পণে প্রবন্ধ ২৩। ব্যাকরণের ভয় অকারণ ২৪। যুগান্তরের ঘুর্ণিপাক ও বাংলাদেশের উপন্যাস ২৫। ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধ, সংকলন ও শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধ, ২৬। আমার রবীন্দ্র অবলোকন, ২৭। আমার নজরুল অবলোকন, ২৮। প্রত্যয় প্রতিজ্ঞা প্রতিভা। ২৯। রবীন্দ্রনাথের গদ্যঃ প্রথম চল্লিশ বছর। ৩০। রবীন্দ্রনাথের সোনারতরী ৩১। প্রসঙ্গ: মৌলবাদ ৩২। জালাল গীতিকা সমগ্র। আত্মজীবনীমূলক রচনা : ৩৩। পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন, ৩৪। পাকিস্তানের ভূত দর্শন। জীবনী গ্রন্থ : ৩৫। চন্দ্রকুমার দে ৩৬। কেদারনাথ মজুমদার ৩৭। সিরাজ উদ্দিন কাশিমপুরী ৩৮। হরিচরণ আচার্য। এছাড়াও নির্বাচিত প্রবন্ধ, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ সংকলনসহ চার খ-ের রচনাবলিসহ আরও বেশকিছু বই প্রকাশিত হয়েছে।
মূলধারার লেখক যতীন সরকার অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৬৭ সালে ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক দিয়ে তাঁর পুরস্কার প্রাপ্তির শুরু। এরপর ‘খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার’ (১৯৯৭), শ্রুতি স্বর্ণপদক (২০০৮), ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব সাহিত্য পুরস্কার (২০০১), ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪১১ পুরস্কার’, বাংলা একাডেমী পুরস্কার (২০০৭), ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী সম্মাননা(২০০৮), আমরা সূর্যমূখী সম্মাননা(২০০৮), ছড়াকার আলতাফ আলী হাসু পুরস্কার(২০০৯) এবং স্বাধীনতা পুরস্কার(২০১০) সহ অনেক পুরস্কার ও পদক পেয়েছেন তিনি। ২০১৩ সালে বিশ্ব শিক্ষক দিবসে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা কল্যাণ সমিতি কর্তৃক পেয়েছেন বরেণ্য শিক্ষক সম্মাননা পান। বইমলো ২০১৭ তে প্রকাশতি হয়ছেে ‘যতীন সরকার রচনা সমগ্র’।
যতীন সরকার উদীচী কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন দু’বার। বাংলা একাডেমীর আজীবন সদস্য তিনি। কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন। মুক্ত বাতায়ন পাঠকচক্রের তিনি উদ্যোক্তা ও সংগঠক। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত রয়েছেন।
তিনি জার্মানি, ইংল্যান্ড, ভারত, পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহ ভ্রমণ করেছেন।