পরশ মির্জাঃ বাউল সাধকদের পুন্যভূমি এই বাংলা। এখানে যুগে যুগে অাগমন ঘটেছে বাউল সাধকদের। তারা তাদের গানে সৃষ্টিকর্তার কথা, সৃষ্টিতত্ত্বের কথা, মানবতার কথা, মানুষের কথা, সহমর্মিতার কথা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলেছেন। তেমনি একজন বাউল সাধক ‘হাছনরাজা’। তবে তিনি অবস্থানগত কারনে ছিলেন অন্যান্য বাউল সাধকদের থেকে ভিন্নতর। সচরাচর অামরা দেখে থাকি অার্থিকভাবে অস্বচছল পরিবারে বাউল সাধকদের অবস্থান ছিল। অার হাছনরাজা জন্মগ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন জমিদার পরিবারে। নিজেও ছিলেন জমিদার। অথচ সম্পদের মোহ তাকে অাটকাতে পারেনি। তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন নির্মল ভাবের জগতে। রচনা করেন অগণিত ভাববাদী গান।
ভাবের জগতে প্রবেশের প্রথম পর্যায়ে তিনি অনেককিছুর হিসাব মিলাতে পারতেন না। মনে বয়ে যেত ঝড়। মনে জাগতো হাজারো প্রশ্ন। অার গানের মাধ্যমে ছুঁড়ে দিতেন সেসব প্রশ্ন। খুঁজতেন উত্তর। যেমন:
“বাউলা কে বানাইল রে হাছনরাজারে?
“অাগুন লাগাইয়া দিল কনে হাছনরাজার মনে?
এ ধরণের প্রশ্ববোধক গানের মাধ্যমে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেন। প্রশ্ন ছোঁড়ে দিতে দিতে একসময় পৌঁছে যান তাঁর কাংখিত গন্তব্যে। ভাসতে থাকেন ভাবের তরঙ্গে, ভাবের মায়ায় ভাবের দেশে। রচনা করতে থাকেন ভাবজগতের সমাধানমূলক অসংখ্য গান। যেমন:
“নিশা লাগিলরে বাঁকা দুইনয়নে নিশা লাগিলরে/হাছনরাজা পেয়ারির প্রেমে মজিলরে।”
“ছাড়িলাম হাছনের নাওরে/হাছনরাজার নাওরে টল টল কোড়া/অারে বৈঠা না চালায়ে নায়ে শূন্যে দিল উড়ারে।”
মোটা দাগে হাছনরাজার গানগুলো উপরোক্ত দু’প্রকারের। যথা, প্রশ্নমূলক ও সমাধানমূলক।
হাছনরাজার ভাববাদী গানগুলোকে অামরা প্রায়শ:ই অপপ্রকাশ করে পরিবেশন করতে দেখি। যা গানের ভাবার্থের সাথে সম্পূর্ণ বেমানান। অামরা অনেক গায়ককেই গানগুলো ভুলভাবে পরিবেশন করতে দেখি। নৃত্যেও গানগুলোর অপপ্রকাশ অপপ্রয়োগ করা হয়। ভাববাদী গানের সাথে খেমটা তালে হইহুল্লুড় জাতীয় চটকদার নৃত্য।
অপপ্রকাশ, অপপ্রয়োগ, অপব্যাখ্যার উদাহরণ হিসেবে এখানে হাছনরাজার দুটি গানের অালোকপাত করা হলো। “অাগুন লাগাইয়া দিল কনে হাছনরাজার মনে?” শিরোনামের গানটি ব্যাখ্যা করলে অামরা জানতে পারি, হাছনরাজা যখন ভাবের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করলেন তখন তাঁর মনে যে ঝড় বইতে শুরু করে বা যে অাগুন জ্বলতে থাকে তার প্রেক্ষিতে তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন এই গানের মাধ্যমে। কে তাঁর মনে অাগুন জ্বালিয়ে দিল? এ অাগুন তো নিভেনা, শুধু জ্বলছেই। এ অাগুনের মাত্রার ব্যাপকতা বুঝাতে তিনি গানটিতে ব্যক্ত করেছেন:
“ধক ধক করে উঠল অাগুন
ধইল অামার প্রাণে/সুরমা নদীর জল দিলে নিভেনা সে কেনে?”
এদিকে হাছনরাজার অত্যধিক জনপ্রিয় “নিশা লাগিল রে” গানটির অবস্হা অথৈবচ। যে যেভাবে পারছে অপব্যবহার করছে সিনেমায়, নাটকে, নৃত্যে। ঢং করে রস দিয়ে গাইছে মঞ্চে। কখনো কখনো ‘নিশা’ শব্দের পরিবর্তে ‘নেশা’ শব্দ জুড়ে দিয়ে গেয়ে উঠে গায়ক। যেন মানব মানবীর প্রেমের রসময় গান। নৃত্যে দেখা যায় খেমটা তালে যুবক-যুবতীদের বাহারি পরিবেশনা। এই গানের মাজেজা কি তাই? এ গানের অর্থ বুঝতে হলে বুঝতে হবে ‘নিশা’ শব্দটিকে। বাংলাভাষায় সরাসরি ‘নিশা’ শব্দ নেই। অাছে ‘নিশানা’। ‘নিশানা’ শব্দের অর্থ হলো লক্ষস্থির করা। ইংরেজিতে যাকে বলে aim। হাছনরাজা গানের তাললয়ের সুবিধার্থে ‘নিশা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যখন ভাবের জগতে লক্ষস্থির করতে পেরেছেন তখনই তিনি গান বাধলেন “নিশা লাগিলরে/বাঁকা দুইনয়নে নিশা লাগিলরে/হাছনরাজা পেয়ারির প্রেমে মজিলরে।” এই গানটিতে পেয়ারি বলতে নারীকে বুঝানো হয়নি। বুঝানো হয়েছে সর্বেস্বরকে। যার প্রেমে তিনি মজেছেন। যা উর্ধ্বমূখী প্রেম। অথচ হালজামানায় এই গানটি পরিবেশন করে বুঝানো হয় মানবমানবীর প্রেম হিসেবে। যা গানের ভাবার্থের সাথে সম্পূর্ণ বেমানান বিপরীত।
বাউল সাধক হাছনরাজার ভাববাদী গানগুলোর ভাবার্থ বুঝেই উপস্থাপনা পরিবেশন করতে হবে। তাহলেই তাঁর গানের ভাবার্থ যথাযথভাবে প্রকাশ পাবে। অার গানগুলোও বেঁচে থাকবে তার নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে। সঙ্গীতজগতের সাথে যারা জড়িত তাদেরকে এক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে বয়োজ্যেষ্ঠদের। কারণ তাদের হাত ধরেই পরবর্তি প্রজন্ম হাছনরাজার গানের ভাবার্থ শিখে ভাবের মশাল প্রজ্জ্বলিত রাখবে সুরের মূর্ছনায়।