শিপলু জামান, ঝিনাইদহ প্রতিনিধিঃ
শিক্ষার হার ছিল খুবই কম,পরষ্পরের হানাহানি, গোষ্টিগত বিরোধ, রাজনৈতিক দ্বন্দ, সামাজিক কলহ এক সময় গ্রামে লেগেই থাকতো। কারও বাড়িতে অনুষ্ঠান হলে শুধুমাত্র নিজেদের অনুসারীদেরকেই দাওয়াত দেয়া হতো। ছোট্র কোন ঘটানাতেও গ্রামের মানুষ পরষ্পরে জড়িয়ে পড়তো সংঘর্ষের মত ঘটনায়। পাল্টাপাল্টি মামলা মোকদ্দর্মার শিকারে হতো অর্থ নষ্ট। সেই গ্রামে আজ বইছে শান্তির সুবাতাস। রাজনৈতিক ভিন্ন মতের মানুষ থাকলেও একে অন্যের উপর আজ শ্রদ্ধাশীল। উন্নয়নে সব বয়সী মানুষ হয়েছে একট্টা। ইতোমধ্যে গ্রামবাসীর সকলের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা হয়েছে স্কুল, ঈদগাহ,মসজিদসহ নানা সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এখন একজনের বিপদ হলে সাহায্যে সকলে ছুটে আসেন। সর্বশেষ সকলের প্রচেষ্টায় শুক্রবার জুম্মার নামাজ শেষে সম্মিলিত কবরস্থানের স্থান নির্ধারন করে ফলক উন্মোচন করা হয়েছে। পুরো গ্রামটিই যেন একটি পরিবার। কথাগুলো গ্রামটির যুবসংঘের একাধিক সদস্যের। অনুকরনীয় এ গ্রামটি ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের কোলা ইউনিয়নের খড়িকাডাঙ্গা।
গ্রামবাসীসূত্রে জানাগেছে, তাদের গ্রামটি কৃষিনির্ভর হলেও বর্তমানে শিক্ষার হার অনেক বেশি। গ্রামের বেশ কিছু কৃতি সন্তান রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কর্মরত আছেন। ভালো ফলাফল করে অনেকে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যায়ন করছে।
গত বুধবার বিকালে সরেজমিনে গ্রামটিতে গেলে স্কুল মাঠে দেখা যায় সাজ সাজ রব। সন্ধ্যা নেমে আসতেই গ্রামের সব বয়সী মানুষ নিজ উদ্যোগেই হাজির হচ্ছেন এ মাঠে। উৎফুল্লতার মধ্যদিয়ে মাঠটি ভরে গেলে মুরব্বীদের সামনে দিয়ে শুরু হয় বিশেষ সভা। সভায় যুব সমাজের পক্ষ থেকে গ্রামে একটি সম্মিলিত কবরস্থান নির্মানের জন্য প্রস্তাব করা হলে গ্রামবাসী সকলেই ভালো উদ্যোগ বলে গ্রহন করেন। এরপর জায়গা নির্ধারন শেষে অনেকেই সভাস্থলে দঁাড়িয়ে জমি দানের ঘোষনা দেন। সভাস্থলে দঁাড়িয়ে মোট ৩৮ শতক দানের জমির পাওয়া যায়। আর যাদের জমি নেই তারা টাকা দেয়ার ঘোষনা দেন। বাকি কাজ সম্পন্ন করতে একটি কমিটি ঘোষনা করা হয়। এরপর গ্রামবাসী সকলে মিলে একদিন পরেই শুক্রবার দুপুরে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন গ্রামবাসীর সাথে থেকে কবরস্থানটির নাম ফলক উন্মোচন করেন।
ওই গ্রামের বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য জালাল হোসেন জানান, অন্য গ্রামের চেয়ে তাদের গ্রামটি বেশ ভিন্ন। কেননা তাদের গ্রামে দীর্ঘদিন ধরে কোন হানাহানি নেই। ইউনিয়নের মধ্যে তাদের গ্রামে সব রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতাদের বসবাস থাকলেও তাদের কারও মনোভাব হিংসাত্বক নয়। এর প্রমান গত কয়েক বছর আগের একটি মাত্র মামলা ছাড়া ১৫ বছরের মধ্যে এ গ্রামে কেউ কারও নামে কোন অভিযোগ বা মামলা করেননি। যে মামলাটি হয়েছে তা মীমাংসার চেষ্টা চলছে। এখন ছোটখাটো কোন ঘটনা ঘটলে গ্রামের সকলে বসেই শান্তিপূর্ণ সমাধান করে থাকেন।
সমাজপতিদের অন্যতম হাজী আব্দুল ওয়াহেদ বিশ্বাস ও শেখ মোহম্মদ হোসেন জানান, তাদের গ্রামের যুব সমাজ অত্যন্ত সৎ,কর্মঠ ও দায়িত্বশীল। তারা যেভাবে গ্রামে উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে তাদেরকে ধন্যবাদ দিতে হয়। তারা জানান, এক সময়ে এ গ্রামটি মানুষ চিনতো হানাহানির গ্রাম হিসেবে। কিন্ত এতে কোন লাভ হয়নি। এ গ্রামে সামাজিক প্রতিষ্ঠান বলতে কিছুই ছিলনা। কিন্ত গত কয়েক বছরের মধ্যে যুব সমাজের উদ্যোগে একটি স্কুল, ঈদগাহ, তিনটি মসজিদের পূণনির্মান হয়েছে। আর নতুন করে হলো সম্মিলিত কবরস্থান। এটা ভাবতেও ভালো লাগছে।
ওই গ্রামের কৃতি সন্তান জানান, গ্রামীন ব্যাংকের যশোর জোনের জোনাল ম্যানেজার মোঃ আলী হোসেন জানান, দেশের যে কোন গ্রামের চেয়ে তাদের গ্রামের চিত্রটা এখন আলাদা। এক সময়ে এ গ্রামের অবস্থা ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। সে অবস্থার আজ আমুল পরিবর্তন হয়ে উন্নয়ন ও সহনশীলতার গ্রামে পরিণত হয়েছে। গ্রামের যুবসমাজ ধনী গরীব, ছোট-বড় সকলের মন জয় করে গ্রামবাসীকে একট্রা করে উন্নয়ন করছে। গ্রামের কেউ অসুস্থ হলে পরিবারের চিকিৎসার সামর্থ না থাকলে গ্রামের সকলেই আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে থাকে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসে গ্রামটিতে মিলেমিলে আয়োজন হয়ে থাকে নানা অনুষ্ঠানের। ফলে এ গ্রাম নিয়ে গর্ববোধ করাই যায়।
কোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন জানান, গ্রামবাসীর সম্মিলিত উদ্যোগে গ্রামটি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এবং এক সময়ের হানাহানি ছেড়ে এখন মিলেমিশে কাজ করে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাসী প্রশংসার পাওয়ার যোগ্য। সবচেয়ে বড় কথা অনেক ঘাত প্রতিঘাতের পর তারা অনেক শিক্ষা পেয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা সকলের মনের পরিবর্তন হয়েছে। তাদের নেওয়া ভাল ভাল উদ্যোগে তিনি খুশি। তাই তাদের সকল কাজে তিনি সাথে থাকবেন।
