পূর্বময় ডেস্কঃ
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের কারণে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে। দলের অভ্যন্তরে কোন্দল এখন প্রকাশ্যে। বিভিন্ন স্থানে ঘটছে সংঘাত, বাকযুদ্ধ, হানাহানি এবং আহত-নিহতের ঘটনা।
অধিকাংশ উপজেলায় আওয়ামী লীগের শত্রু আওয়ামী লীগই। ভয়াবহ কোন্দলে বিপর্যস্ত দলের তৃণমূল। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। কিন্তু বিদ্রোহীদের পক্ষাবলম্বনকারী মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছেন না তৃণমূলের অনুগত নেতারা। তাঁদের দাবি, বিদ্রোহী প্রার্থীরাই হলো দলের সিদ্ধান্ত অমান্যকারী মূল অপরাধী। আর বিদ্রোহীদের পক্ষাবলম্বনকারীরা হলো অপরাধীর সহযোগী। মূল অপরাধীদের শাস্তি না দিয়ে সহযোগীদের শাস্তি দেওয়া হবে এটা কেমন কথা? সহযোগীদের পাশাপাশি মূল অপরাধী হিসেবে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জোর দাবি জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতারা।
জানা গেছে, সারাদেশে তৃণমূল নেতাদের এ দাবিটি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুলে ধরবেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। আগামী শুক্রবার গণভবনে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের এক সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে বিষয়টি তুলবেন নেতারা।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রথম থেকেই বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে নমনীয় আওয়ামী লীগ। বিদ্রোহ দমনে কেন্দ্র থেকে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের মুখেও এ নিয়ে কোনো সাড়া-শব্দ নেই। এ কারণে তৃণমূলে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
বিএনপিহীন নির্বাচনী মাঠে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগই। ফলে নিজেরা একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছেন। চরিত্র হননেও পিছপা হচ্ছেন না কেউ কেউ। অনেকে অপপ্রচার করেও প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের চেষ্টা করছেন। এতে করে তৃণমূল আওয়ামী লীগে যে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে সেটি সবারই জানা। নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও অহরহ ঘটছে। অনেক স্থানে চলছে ঠান্ডা লড়াই। যেকোনো সময় বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটারও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য জানান, উপজেলায় বিদ্রোহীদের পক্ষাবলম্বনকারী মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে হয়েছে। তবে বিদ্রোহী ও তাদের পক্ষাবলম্বনকারী নেতাদের (যাঁরা মন্ত্রী-এমপি নন) বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিদ্রোহীদের শাস্তি দিতে তৃণমূলের দাবির বিষয়টি আগামী শুক্রবার আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের সভায় তিনি উত্থাপন করবেন বলে জানিয়েছেন।
উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলার কারণে ভেঙে পড়েছে সাংগঠনিক চেইন অব কমান্ড। দলের ২১তম সম্মেলনের মাত্র পাঁচ মাস আগে এ ধরনের পরিস্থিতিকে কিছুটা উদ্বেগজনক বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ। দলের সর্বোচ্চ ফোরাম প্রেসিডিয়ামের বৈঠকে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দিয়ে এখন থেকেই সংগঠনকে গতিশীল ও গোছাতে নির্দেশ দিয়েছেন। পরে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা ও পরিকল্পনা করেছেন। ৫০ সদস্যের ৮টি টিমে ভাগ হয়ে তারা তৃণমূল নেতাদের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দলের উপদেষ্টা পরিষদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে এ টিম গঠন করা হবে। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যরা টিমগুলোতে নেতৃত্ব দেবেন। কাউন্সিলের আগ পর্যন্ত এ টিম কাজ করবে।
নেতারা জানান, মূলত দুটি টার্গেট নিয়ে সাংগঠনিক সফর করবে আওয়ামী লীগ। প্রথমত, উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে যে সব এলাকায় দলীয় কোন্দল চরমে উঠেছে তা চিহ্নিত করে কোন্দল মেটানো। সেখানে দলীয় শৃঙ্খলা ফেরানো। দ্বিতীয়ত, সম্মেলনকে ঘিরে দল যেনো পূর্ণমাত্রায় উজ্জীবিত থাকে, নেতিবাচক রাজনৈতিক কোনো ইস্যু তৈরি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা।
কোন্দলে সংগঠন দুর্বল হয়, দেশকে এগিয়ে নিতে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী সংগঠন দেখতে চান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা— এমন বার্তাই তৃণমূলে পৌঁছে দেওয়া হবে। ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে টানা অষ্টমবারের মতো আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ওই সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক হন ওবায়দুল কাদের। আগামী অক্টোবরেই এ কমিটির মেয়াদ তিন বছর পূর্ণ হবে। দলটির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, তৃণমূলে সম্মেলনের মাধ্যমে এ কোন্দল নিরসন করা সম্ভব হবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও দলের অভ্যন্তরে এতটা কোন্দল তৈরি হয়নি। উপজেলা নির্বাচনে তৃণমূলের সম্পৃক্ততা বেশি। তারাই হচ্ছে দলের প্রাণ। তাই দলকে সুসংগঠিত রাখতে তৃণমূলকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে বিভেদ থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আওয়ামী লীগ। তারা জানান, তৃণমূলের কোন্দল নানা কারণে তৈরি হয়েছে।
বিশেষ করে স্থানীয় এমপিরা অনেক এলাকায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছেন। নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে অনেক এমপি নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এসব বিষয়কে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা স্বাভাবিকভাবে নেননি বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। বিদ্রোহীদের পক্ষাবলম্বনকারী মন্ত্রী-এমপিদের দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে প্রথমে কারণ দর্শানো নোটিস দেওয়া হবে। এরপর কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বৈঠকে বলেছেন, নৌকার বিরোধিতাকারীরা ভবিষ্যতে নৌকা প্রতীক পাবেন না। যেহেতু তাদের নৌকার প্রার্থী পছন্দ নয়, তাই তাদের নৌকা নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এ পর্যন্ত চার ধাপে ৪৪৪ উপজেলার ১৩৬টি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ৩০৪টি উপজেলায় জিতেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা। এরমধ্যে ১০৭ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা) ৩টিতে জয়লাভ করেছে। অন্যদিকে ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি-জেপির প্রার্থী একটি উপজেলায় বিজয়ী হয়েছেন।