পরশ মির্জা ঃ অারমাত্র কয়েকদিন পরেই অামাদের প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ। ফিবছর দেখা যায় পহেলা বৈশাখে অামরা অনেকেই মজা করে পান্তাভাত খেয়ে থাকি। নববর্ষে পান্তা ভক্ষণ কি অামাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের খাবার? সংস্কৃতির মাঝে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ রোধে পান্তা ভক্ষণের বিষয়টি অাসলেই যৌক্তিক কি-না তা ব্যাখ্যার দাবী রাখে।
অার্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে বাংগালী জাতির অতীত জীবনধারা কিছুটা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। অতীতে গ্রামীণ কৃষিপ্রধান এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনমান ছিল দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত। অার্থিক দৈনাদশা সারাবছরই লেগে থাকতো। অধিকাংশ পরিবারেই তিনবেলা খাবার জুটতো না। সাধারণ মানুষ খেয়ে না খেয়ে জীবন অতিবাহিত করতো। অায় ছিল নিম্নগতির। খেটে খাওয়া গ্রামীণ গরীব নিরন্ন মানুষেরা তাই রাতে যদি খাওয়ার পরে ভাত থেকে যেত তাহলে সেগুলো উচ্ছিষ্ট হিসেবে ফেলে দিত না। পানি দিয়ে ভিজিয়ে রেখে দিত যাতে পঁচে না যায়। রাতে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা ভাতগুলোই সকালে কাঁচা মরিচ বা পোড়ানো শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ, লবণ দিয়ে খেয়ে নিত। অর্ধেক বেলা পার করে দিত। এমনকি পূর্বের রাতের পানি ভেজানো ভাত সকালে খেয়ে সারাদিনই পার করে দিত। রাতে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হতো বলে ভাতগুলো পান্তা হিসেবে অাখ্যায়িত হয়। প্রশ্ন এসে যায়, কেন খেতো? সহজেই অনুমেয়। অনন্যোপায় হয়ে খেতো। কারণ প্রতিদিন সকালে গরম ভাত পেটে দেয়ার সামর্থ্য তাদের ছিল না।
অতীতের মতো বর্তমানের চিত্র কি? বর্তমানেও একই চিত্র। নিম্নঅায়ের গ্রামীণ ও শহুরে বস্তিবাসী খেটে খাওয়া মানুষ রাতে খাবারের পর ভাত যদি অবশিষ্ট থেকে যায় তাহলে তা ফেলে না দিয়ে অতীতের অসহায় মানুষদের মতই পানিতে ভিজিয়ে রেখে দেয়। পরবর্তী দিন সকালবেলায় পিঁয়াজ, মরিচ লবণ দিয়ে খেয়ে নেয়। কেন খায়? পুর্বপূরুষদের মতই অনন্যোপায় হয়ে। এই হলো অাবহমান বাংলার গরীব খেটে খাওয়া মানুষদের পান্তা ভাত খাওয়ার চিত্র ও কারণ।
অতীত ও বর্তমানের চিত্র ঘেটে অামরা দেখতে পাই, পান্তা ভাত হচ্ছে খেটে খাওয়া নিরন্ন গ্রামীণ ও শহুরে বস্তিবাসী অসহায় মানুষদের নিত্যদিনের খাবার। কারণ, প্রতিদিন সকালে গরম ভাত বা অন্যকোন নাস্তা খাওয়ার সামর্থ তাদের নেই বা
থাকে না। তাই নিরুপায় হয়ে বাঁচার তাগিদে রাতের অবশিষ্ট ভাতগুলো ফেলে না দিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকালে খেতে হয়।
গত কয়েক দশক যাবত অামরা কিছু শহুরে মানুষ অতি উৎসাহী হয়ে অতি সংস্কৃতবান সেজে পান্তা ভাতকে তুলে ধরার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছি বাঙালীর সার্বজনীন উৎসব নববর্ষের প্রধান খাদ্য হিসেবে। দিনদিন এই অপসংস্কৃতির চিত্রটি বিস্তার লাভ করছে। এটা অসহায় নিরন্ন মানুষদের নিত্যদিনের খাবার নিয়ে পরিহাস, উপহাস বা মসকরা বৈ কিছু নয়।
বর্তমানে অামরা নববর্ষে পান্তাভাত খাওয়ার জন্য ব্যয় করি শত শত হাজার হাজার টাকা। এই পান্তাভাত কি নববর্ষের দিন ব্যতীত অন্যদিন অামরা খাই? কখনোই খাই না। একটি খাবার তখনই একটি জাতির সার্বজনীন বা সাংস্কৃতিক খাবার হয়, যখন তা সকলে সকল সময় খেতে পারে বা খায়। অামি শুধুমাত্র বছরে একটি দিন মজা করে খেতে পারি, অন্যদিন তার ঘ্রাণও সহ্য
করতে পারি না, তা কি করে অামাদের সার্বজনীন উৎসবের সার্বজনীন বা সাংস্কৃতিক খাবার হয়? তা কি অামরা একটিবার তা ভেবেছি?
অাসলে পহেলা বৈশাখে ধুমধাম অায়োজনে গাছের তলায়, হোটেল রেস্তোরা, ডাইনিং টেবিলে বসে পান্তা খাওয়া অসহায় উপায়হীন গরীবের নিত্যদিনের খাবারের প্রতি অবজ্ঞা বৈ কিছু নয়। অামরা কেউ তা জেনে করি, কেউ না জেনে করি। প্রতি নববর্ষে এ চিত্র দৃশ্যমান হয়। অাবহমান বাংলার সার্বজনীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মাঝে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছি মজা করে হইহুল্লুড় করে পান্তা ভাত খাওয়ার অপসংস্কৃতি। বাংগালী সংস্কৃতির সার্জনীন রূপকে স্বচ্ছ রাখার স্বার্থে পান্তা ভক্ষণের অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে অাসাটা অতীব জরুরী। তাই অাসন্ন নববর্ষের প্রাক্কালে বিষয়টি ভেবে দেখার দাবী রাখে।