শম্পার বিয়ের একটা বছর পার হলো। শম্পাকে কখনো এক মুহূর্তের জন্যও বিষন্নতায় বা কষ্ট পাওয়া অবস্থায় মন খারাপ করে থাকতে দেখে নি কৃষাণ। শুধু শম্পার স্বামী কৃষাণ ই নয়, শম্পার শ্বশুরবাড়ির কেউ ই নয়। সব সময় মুখে হাসি লেগেই থাকে শম্পার। কৃষাণের হাতে সিগারেট কিংবা শ্বশুরমশায়ের বেশিক্ষণ ছাতি ছাড়া রোদে বাইরে থাকা কিংবা শাশুড়ি মায়ের অতি পান ভক্ষণ এগুলো শম্পা কখনো ই সহ্য করে নি। সবসময় শম্পা তাদেরকে শাসন করেছে। সংসার টা কে প্রাণবন্ত করে রেখেছে এই সম্পা ই। সব হাসিমুখে।
শম্পা বিয়ের দিন থেকে এই সংসারে আসার পর থেকে এতদিন পর্যন্ত সংসারটাকে এমন ভাবে গড়ে তুলেছে, যেন শম্পা ছাড়া এই সংসার কল্পনাই করা যায় না। সংসারের সব হিসাবকিতাব খুব সুন্দরভাবেই গুছিয়ে রাখে মেয়েটা।
কৃষাণ ধনগোপাল মিত্রের একমাত্র ছেলে। ব্যাংকে চাকরি করে। সরকারি ব্যাংক অফিসার। মাইনেও বেশ মোটা তাজা। সুতরাং সংসারে অভাব হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
বছরখানিক আগে শম্পার সাথে ধুমধাম করে, বেশ খরচাপাতি করেই বিয়ে হয় কৃষাণ আর শম্পার। দক্ষিণ মনিসিংহ পাড়ার মনোজ সিংহের তিনটি মেয়ের সব চেয়ে ছোট মেয়ে টি ই শম্পা। বড় দুটোর আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। বি.এ. শেষ করেছে শম্পা। যদিও আরো অনেক পড়াশুনার ইচ্ছে ছিল শম্পার। কিন্তু সংসারটাকে গুছাতে গুছাতে আর হয়ে উঠলো না।
যাই হোক শম্পার বিয়ের এই একটা বছর বেশ আনন্দেই কাটলো। বাড়িতে সবাই শম্পার প্রতিটা কাজের জন্য সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। অন্যসকল মেয়েদের থেকে শম্পা একটু বেশিই আলাদা।
অবসরে শম্পা বাড়িতে ডিভিডি প্লেয়ারে সবাই কে নিয়ে ভুতের বা লোমহর্ষক সব মুভি দেখে। ছুটির দিনে কৃষাণ কে নিয়ে ঘুরতে যায়। কিন্তু তার চাহিদা একেবারেই অল্প। কৃষাণের কাছ থেকে সে কখনো কিছু আবদার করে নি আজও। আর তাদের বউ শাশুড়ির সম্পর্ক যেন দুই বান্ধবি যেটা বাংলার ঘরে আজ লক্ষই করা যায় না। এই তো সেদিন দূর্গাপূজোর অষ্টমী তে শাশুড়িকে সাথে নিয়ে শহরের সবকটা মন্দিরে ঘুরে এসেছে। আর পথে আসতে যেতে তাদের জীবনের কত ভ্রমণকাহিনী যে হয়েছে দুজনের মুখে তা বউ শাশুড়ির কেউই গুনে নি।
কিন্তু আজ এই সদা হাসিখুশি আর উদ্দমী নবযৌবনা মেয়েটির কি এমন হলো যে মুখে একটুও হাসি নেই। বিবর্ণতা আর শোকপূর্ণ মুখ দেখা যাচ্ছে তার। আজ সন্ধাটাও যেন এই শোকের সাথে মিশে যাচ্ছে। আকাশে চাঁদ উঠেনি আজ। চাঁদ উঠেনি যে ঠিক তা নয়। মেঘের নিচে ঢাকা পড়েছে বলে দেখা যাচ্ছে না। শুধু মাঝে মাঝে মেঘ গর্জন করছে। একেবারেই মনমরা সন্ধ্যা যাকে বলে। শম্পা বসে আছে বিছানায়। মাঝে মাঝে দু চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। ভেতর থেকে একটা কি এক যন্ত্রণার চিৎকার যেন তার মুখ দিয়ে বের হতে চাচ্ছে। কিন্তু সে চাপিয়ে রেখেছে সে চিৎকার।
কৃষাণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট শেষ করছে একটার পর একটা। বাড়ির অন্যান্যরাও চুপচাপ। মুখে সবার শোক ছায়া।
কি হলো? ঠিক কি কারণে শম্পাসহ অন্যান্যদের এই হাল একমুহূর্তের ব্যবধানে? পরিবেশটা ই বা কেন আজ এমন প্রতিকূলে?
সবটা ই বলছি। সেদিন সকালে কৃষাণের জন্য চা আনতে গিয়ে হঠাৎ শম্পা রান্নাঘরের সামনে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায়। তারপর বাড়িতে ডাক্তার কমলচন্দ্র দাস এসে দেখেন। তারপর তাঁর নিজস্ব নার্সিংহোমে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। আজ সন্ধ্যায় রিপোর্ট দিল। রিপোর্টটা এই খানিকক্ষণ আগে কৃষাণ নিয়ে আসলো কমলবাবুর চেম্বার থেকে।
রিপোর্টে কি লেখা ছিল?
লেখা ছিল যে শম্পা কখনো মা হতে পারবে না।
:'(
চাঁদটা এখনো মেঘের তলেই।