সৈয়দ আরমান হোসেন ইমনঃ
আরেকটি বসন্তের আগমন। ডালে ডালে, শাখায় শাখায় নতুন ফুল ফুটেছে। কোকিল কুহু কুহু গাইছে। নতুন ফুলের মিষ্টি গন্ধে প্রকৃতি সুশোভিত হয়ে গেছে। কিন্তু তার মধ্যেও হৃদয়ে একটা হারানোর বাঁশি বাজছে। যাঁরা এই বসন্তের প্রথম পক্ষেই তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সেই ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ কখনো ভুলার নয়।
জাতি হিসেবে একমাত্র আমাদের আছে মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনের প্রায় ৬৭ বছর চলছে কিন্তু সর্বত্র বাংলাভাষার সুষ্ঠু ও সর্বোচ্চ প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে পাকিস্তানিরা আমাদের মায়ের মুখের ভাষা বাংলা নিয়ে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। প্রতিবাদে শুরু হলো বাংলার দামাল ছেলেদের ইতিহাসখ্যাত ভাষা আন্দোলন। ভাষা শহীদ জব্বার, সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর সহ নাম না জানা অনেকের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের বাংলা ভাষা। এই ইতিহাস কারও অজানা নয়। বাংলা বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণই যেন সেই শহীদদের প্রতিচ্ছবি।
ভাষা আন্দোলন কেন হয়েছিল? অবশ্যই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদা
রক্ষাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। আন্দোলনের পরিণতি হিসেবে আমরা পেলাম রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এরপর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে অন্যতম
রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায় বাংলা ভাষা। এখন গোটা
দুনিয়া আমাদের মাতৃভাষাকে সম্মান জানিয়ে
‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালন করছে।
কিন্তু আমাদের দেশেই ভাষাকে অবহেলিত করা
হচ্ছে ভাষার বিকৃত শব্দ প্রয়োগে। আমরা দৈনন্দিন জীবনে বাংলা শব্দ চয়নে ও ব্যবহারে কতটা যত্নশীল? ইতিমধ্যে আমরা শিক্ষিত বাঙালিরা বাংলা ও অপ্রয়োজনীয় ইংরেজির সংমিশ্রণে এক অদ্ভুত ‘বাংলিশ’ ভাষার প্রচলন করেছি। পুরো বাক্যটা বাংলায় বা পুরো বাক্যটা ইংরেজিতে বললে তা অবশ্যই ঠিক আছে। কিন্তু আধো বাংলা আর প্রয়োজন ছাড়া আধো অপ্রয়োজনীয় ইংরেজি বললে সেটা কখনো আধুনিকতার পরিচয় হতে পারে না। বরং ভাষার অবমাননা হয় ও ভাষার বিকৃতি হয়। যেমন- অনেকে ঢং করে বলে , “আমি গিটার প্লে করবো”। এটা না বলে “গিটার বাজাবো” বললে কি সমস্যা? আবার অনেকে বলে, “আমি তোমাকে আন্ডারস্টেন্ড করাতে পারবো না”। এর পরিবর্তে “আমি তোমাকে বুঝাতে পারবো না” বললেই বা কি সমস্যা? এমন হাজারো রকম উদাহরণ দেয়া যাবে।
ভাষার এরকম বিকৃতি মোটেও সমীচীন নয়।
সাম্প্রতিককালে হিন্দী শব্দ আমদানি করে
সেটাকে ‘বাংহিংলিশ’-এ পরিণত করেছি।
পারস্পরিক ভাব বিনিময়কে সহজ করাই ভাষার
প্রধান কাজ। আর সেটি করতে গিয়ে যদি
বিদেশি শব্দ ব্যবহার করা হয়, তাতে অন্যায়ের
কিছু নেই। কিন্তু সহজে ভাব বিনিময়ে পর্যাপ্ত
বা প্রয়োজনীয় শব্দ বাংলা ভাষার ভান্ডারে থাকার
পরও বিদেশি শব্দের অপব্যবহার করলে তাতে বাংলা ভাষার মর্যাদা ক্ষুন্নই হয়। অফিস
আদালত, ব্যাংকবীমা, বহুজাতিক কোম্পানীসহ
প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রামে ইংলিশ বাংলা ও হিন্দি
সংমিশ্রনে আধুনিকতার নামে অদ্ভুত প্রয়োগ করা
হচ্ছে বাংলা ভাষার। যেমন – অনেক প্রতিষ্ঠানের
ফরমে বাংলা ইংরেজি সংমিশ্রনে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলা ভাষা।
এই ভাষা কবিগুরুর ভাষা, নজরুলের
ভাষা, লালন-হাছনের ভাষা সর্বোপরি আমার মায়ের ভাষা। কবি অতুল প্রসাদ সেন বলেছেন, “মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা। ” বেঁচে থাকুক বাংলা, সুরক্ষিত হোক ভাষার স্বকীয়তা, যথাযথ হোক বাংলা ভাষার ব্যবহার ব্যক্তিজীবন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্র।